.............খোলা চিঠি
"স্কুলব্যাগ"জাতির মেরুদন্ড সোজা করতে শিক্ষার্থীর মেরুদন্ড বাঁকা করা বন্ধ করুন।
রহিমা আক্তার মৌ
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী,
আশাকরি
আপনি খুবই ভালো আছেন। জানিনা আপনার হাঁড়ের বা এলার্জির কোন সমস্যা নেই।
শীতের দিনে এই দুটি রোগ বহনকারীদের অবস্থা খুব খারাপ। যাক আগে আপনাকে দুটি
চিঠি দিয়েছি। একটা ছিল নতুন বই নিয়ে, আরেকটা ছিলো প্রতিবছর স্কুল থেকে
বাধ্যতামূলক গ্রামার বই কেনার বিষয়ে।
বছরের প্রথম শত
শত টাকা দিয়ে মোটা মোটা গ্রামার বই কিনে বছর শেষে সের ধরে বিক্রি করা ছাড়া
উপায় নাই। বস্তির পোলাপাইনকে দিলেও পড়ায় কামে আসে না। কারণ ওদেরকেও এমন
বাধ্যতামূলক বই কিনে পড়তে হচ্ছে। আপনারা যে গ্রামার বই গুলো দেন তা স্কুলের
শিক্ষকরা মাসে একদিন নাড়াচাড়া করে দেখেন। উনারা দেয়া মোটা মোটা বইগুলোই
উনাদের বেশ পছন্দ। তাও আবার প্রতিদিন স্কুলে আনতে হয়। সেই বইয়ের ব্যাগ
বাচ্চা টানতে না পারলে মা, বাবা কে দিয়ে আনতে হয়। তবুও সেই বই আনা চাই চাই।
থাক
সে সব পুরানো সরিষার গন্ধহীন কাসুন্দির কথা। তবে আজ যা বলব তা পুরানো চালে
ভাত বাড়ে, তেমনি গল্প। শুনেছি গল্প আপনি খুব পছন্দ করেন। আমি ঘুছিয়ে গল্প
বলতে পারলেও সমস্যা অন্য জায়গায়। আমার উচ্ছারণে ভুল হয়। এই ভুলটা আমার দোষ
নয়, এটা আমার জন্মস্থান গত ভুল। আমি নোয়াখালীর মেয়ে। এখন 'প' কে 'হ' না
বললে ও 'স' কে আমি 'ছ' বলি। 'শ' কে আবার 'চ' বলি। যারা মন দিয়ে শুনে তাদের
এই উচ্ছারণ গুলো আবার খুব কানে লাগে। এই কথা এমনি এমনি বলিনি। বিশাল কারণ
আছে বলেই বলা। যাক আজ সেসব নাই বলি। কখনো আমার লেখা "বর্ণ " নামের গল্পটা
চোখে পড়লে জানতে বুঝতে পারবেন। তবে এটাও সত্যি এক সময় আমি 'প' কে 'হ'
বলতাম। 'ফ' কে 'প' বলতাম। 'প' কে 'ফ' বলতাম। 'ব' কে 'ভ' বলতাম। 'ভ' কে 'ব'
বলতাম। শুধু কি তাই, 'ঝ' 'জ' 'য' এর উচ্চারণ তো সারা জীবন একই করে গেলাম।
তবে লেখার সময় ভুলটা কম হয়। আগে যতটা হতো এখন ততটা কম হয়। পাশে মেয়েরা
থাকলে ওদের থেকে জেনে নিই ঝাড়ুর 'ঝ' হবে নাকি জেলের 'জ' হবে, নাকি যাই এই
'য' হবে। আজো ওরা আমায় নিয়ে হাসে। আজব ব্যাপার আমি কিন্তু আমার সন্তানদের
ভুল শিখাইনি।
আচ্ছা আজকের
বিষয় হলো "ব্যাগ"। অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগ বহন করে স্কুলে যাওয়া শিশুদের কথা।
সেদিন সকাল বেলা সময় ৭'২৭ মিনিট হবে সংসদের সামনে হাটতে গেলাম। নিয়মিত এক
পথে হাটতে যাই না কিন্তু। দুর থেকে চোখে পড়লো এক বাবা আর ছেলেকে। দুজনের
কাঁধে কলার কাঁদি। ছেলের বয়স ১০/১২ হবে। বাবার গায়ে ছেঁড়া শার্ট পরলে মলিন
লুঙ্গি। পায়ে আধা ছেঁড়া প্লাস্টিকের ছাউনি দেয়া সেন্ডেল। ছেলের পরনে ময়লা
শার্ট, পুরানো লুঙ্গি আর পায়ে দুই রংয়ের দুই ফিতার সেন্ডেল। মিল শুধু একটাই
ঘাঢ়ের কলার কাঁদিটা। অবশ্য ছেলের ঘাঢ়ের টা ছোট বাবার চেয়ে। এই দৃশ্য দেখে
ভাবছি ওর ও এই বয়সে স্কুলে থাকার কথা। ঠিক সেই সময়ে ওদের পাশে দেখতে পাই
আরেক বাবা ছেলেকে। বাবা শার্ট প্যান্ট ইন করা। পায়ে চকচক করা কালো সু। ছেলে
স্কুল ড্রেস পরা সাথে জুতো। এই বাবা ছেলেদের মাঝে বাবার কাঁধে বা পিঠে
কিছুই দেখা যায় না কিন্তু ছেলের পিঠে ইয়া বড় একটা বোঝা। এটা আম, জাম বা
কলার বোঝা নয়। ইহা আমাদের জ্ঞ্যানের বোঝা। মানে বইয়ের বোঝা। জানিনা ব্যাগটা
বাবার কাঁধে না হয়ে ছেলের কাঁধে কেনো। জবাব কয়েকটা হতে পারে। হয়তো বাবা
চাচ্ছেন ছেলে বোঝা টানার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করুক। নয়তো আমার দেখার
পূর্ব মুহূর্তে বোঝাটা বাবার কাঁধেই ছিলো। নয়তো সে বাবা আমার মতো
মেরুদন্ডের সমস্যায় ভুগছেন। এগুলো পজেটিভ ভাবনা। নেগেটিভ ভাবনাও আমি ভাবি,
সেটা হলো ব্যাগটা কাঁধে নিলে হয়তো বাবার শার্টের ইন নষ্ট হয়ে যেতো। অফিসে
গেলে পাশের চেয়ারে বসা সুন্দরী আপায় কইতো --
কি খবর আজ মনে হয় বউ শার্ট ইস্ত্রি করে দেয়নি। হাহাহা।
যাক
সেসব, একটু মজা করলাম। আমার ছোট মেয়েটা এবার ৭ম শ্রেনী থেকে পরীক্ষা
দিচ্ছে। আপনাদের দোয়ায় পাশ করলে ৮ম শ্রেনীতে উঠবে। ৮ম শ্রেনী মানেই তো
আপনাদের সেই জে এস সি পরীক্ষা। বাচ্চা সহ বাচ্চার বাবা মায়ের দৌড়াদৌড়ি। এরই
মাঝে আমি অংক, বিজ্ঞান আর ইংলিশের প্রাইভেট রেডি করে রেখেছি। যেদিন ৭ম
শ্রেনীর পরীক্ষা শেষ হবে, তার পরের দিন তাকে সেই প্রাইভেট গুলো শুরু করতে
হবে। পরীক্ষার পর ঘুরাঘুরি বন্ধ। ঘোষণা করেছি বেঁচে থাকলে ২০১৮ সালের
নভেম্বরের শেষ দিকে ঘুরাঘুরি হবে। তখন আপনাদের ঘোষিত জে এস সি পরীক্ষা শেষ
হবে। মেয়েটার স্কুলের ক্লাস রুম ৩য় তালায়। ১৫/১৬ কেজি ওজনের ব্যাগ কাঁধে
নিয়ে সে স্কুলে যায়। সিঁড়ি বেয়ে ৩য় তালায় উঠে। ব্যাগ রেখে নিচে নামে
এসেম্বলি করে আবার উপরে উঠে। টিফিন সময় নামে আবার উঠে। ক্লাস শেষে সে এই
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ম্যাডামের বাসায় যায়। খুব কষ্ট হয় ওর। মাঝে মাঝে বাসা
থেকে বের হওয়ার সময় ও বাবাকে বলে--
ধরে দেখো।
উনি ধরে বলেন--
এত্ত ওজন দুইটা বই রেখে যা।
মেয়ে বলে--
দিদির বকাটা কি তুমি খাবা। ( স্কুলের শিক্ষককে ওরা দিদি ডাকে)
আমি
আগে থেকেই মেরুদন্ডের সমস্যায় ভুগছি বলে ব্যাগ বহন করা আমার নিষেধ। ৪০ বছর
বয়সে আমি যে ব্যাথাগুলোর কথা বলি আমার ১৩ বছর বয়সের মেয়েটা সে সব ব্যাথার
কথা বলে। আমি হাসপাতালে গিয়ে থেরাপি নিই। বাসায় এসে ওকে থেরাপি আমাকেই দিতে
হয়। আমার সন্তানের ভবিষ্যতের কথা মনে উঠলে ঘুমে নয় জেগে থাকা অবস্থায় আমি
আৎকে উঠি।
আপনার কাছে বিনীত আবেদন পারলে এইসব
শিশুদের পিঠ থেকে, ঘাঢ় থেকে, হাত থেকে বোঝাটা নামিয়ে নিন। ফিজিও থেরাপি
রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। জাতির মেরুদন্ড সোজা রাখতে গিয়ে ওদের
মেরুদন্ডের তেরোটা বেজে যাচ্ছে। এই শিশুদের ভবিষ্যৎ কিন্তু অন্ধকারের
দিকে। যে আলোর পথে নেয়ার জন্যে আমরা ওদের স্কুলে পাঠাই সেই আলো দেশ কতটা
পাবে জানিনা, তবে ওদের যে ভবিষ্যৎ অন্ধকার তা নিশ্চিত। আমি গত ৩/৪ বছর
থেকে থেরাপি নিই। এখন নিজে নিজে বাসায় নিচ্ছি। টাকার আর কর স্রাদ্ধ করবো।
থেরাপি নিতে গিয়ে অনেক রোগীর সাথে আমার কথা হয়েছে। কেনো ওদের এই অবস্থা তা
জানতে গিয়ে অনেক অজানা তথ্য পেয়েছি। পত্রিকায় কিছু কিছু বিষয় নিয়ে লিখেছিও।
আমার সন্তানরা লেখা দেখে বলে--
মা লিখে কি আসলে কিছু হয়। কেনো লিখো এসব।
আমি জবাব দিই--
দশটা লিখে যদি একটার ফয়দা হয়। সেই আশায় লিখি।
লিখলে
আরো অনেক কিছুই লিখতে পারি। কিন্তু এক সময় তো ঠিক ইতি টানতেই হবে। আজ
এখানে ইতি টানলাম। আমার মতো হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মায়ের আকুতি দয়া করে
আমাদের সন্তানদের পিঠ থেকে, ঘাঢ় থেকে, হাত থেকে বোঝাটা নামিয়ে নিন।
সন্তানকে নিয়ে দেখা আগামির স্বপ্ন যেন দুঃস্বপ্নে পরিনত না হয়। ভালো থাকুন,
আপনার সুন্দর জীবন সুস্থ শরীরের প্রত্যাশা করে বিদায় নিচ্ছি। তবে খুব
শীঘ্রই আসছি আবার সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে।
ইতি
আপনার দুই শিক্ষার্থীর মা
আর বাংলাদেশের এক সাধারণ নাগরিক,
(জন্মসূত্রে ও অনুমোদন সূত্রে)
লেখক: সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।
No comments:
Post a Comment