Jagrotobibek24

তথ্য, বিনোদন, সমাজ, বিজ্ঞান ও সাহিত্য সমৃদ্ধ একটি সুন্দর ব্লগ

Sponsored by: VINNOMATRA

GoRiseMe.com

Followers

Monday 7 January 2019

চলনবিলাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা



চলনবিলাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা
মোহাম্মদ অংকন






বর্ষায় বিল আর গ্রীষ্মে আবাদী জমি, এই নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল। এই বিলকে কেন্দ্র করে চাষীরা যেমন স্বপ্ন বপন করে, তেমনি জেলেরা স্বপ্নের জাল বুনন করে। বিলকে কেন্দ্র করে শুধু চাষী ও জেলেরাই স্বপ্ন দেখে না, স্বপ্ন দেখে চলনবিলাঞ্চলের প্রতিটি মানুষ এবং দেশবাসী আশায় থাকে চলনবিলে পাদিত ধান ও স্বাদু পানির নানা প্রজাতির মাছের জন্য। পর্যটন আকর্ষক হিসাবেও চলনবিলের নাম সু-বিস্তৃত।

ভরা বর্ষায় চলনবিল হয়ে ওঠে অনন্তযৌবনা। অঢেল পানির মাঝে মাঝে দেখা মেলে কৃষকের বোনা আমন-আউশ ধান। আর অথৈ পানিতে নৌকা ভাসিয়ে জেলেরা মাছ ধরে। চলনবিলে প্রায় ৩৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বোয়াল, শোল, পুটি, পাবদা, খলসে, শিং, বেলে, চিংড়ি, আইড়, কই, বাইয়েমসহ বিভিন্ন সুস্বাদু মাছ। জেলেরা শেষ রাতে জাল ও নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে বিলে চলে যায়। সকাল অবধি তারা মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। আবার অনেকে বড়শি, খড়া জাল, ধর্মজাল, ঝাঁকিজাল, সুঁতিজাল দিয়েও মাছ শিকার করে। এসব মাছ এলাকার স্থানীয়দের চাহিদা পূরণ করার পর তা দেশের আনাচে কানাচে পৌঁছে যায়। সেই সাথে সারা দেশে চলনবিলের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে চলনবিলের মাছ বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে।

বর্ষার পানি শেষ হতেই চলনবিলের কৃষকরা মাঠে নেমে পড়ে। পাঁকা আমন-আউশ ধান কেটে ঘরে তোলে। তারপর জমি থেকে ধানের আগাছা পরিষ্কার করে ইরি ধান চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করে। সবাই ইরি ধানের বীজতলা তৈরির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাস দুয়েক পর চলে আসে ইরি মৌসুম। কৃষকরা চলনবিলের মাঠে ধান লাগাতে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যায়। কেউ কেউ জমির আইল বাঁধে, কেউ কেউ পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করে আবার কেউ কেউ জমিতে পানি দেয়, মই দেয়। তখন শীতকাল চলে। কুয়াশা ভেদ করে দলবেঁধে কৃষকরা ধান রোপন করতে হেঁটে হেঁটে জমিতে যায়। তাদের মাথায় ধানের বীজের বোঝা ও হাতে পানতা ভাত। সূর্য উঠার আগেই তারা যেন বিঘাকে বিঘা জমিতে ধান রোপন করে ফেলে। তাদের সারিবেঁধে কাজের দৃশ্য যেন সত্যই অপূর্ব। আরও অপূর্ব লাগে যখন তারা কণ্ঠে আঞ্চলিক গানের সুর তোলে। কাজের আনন্দে গান গেয়ে তারা যেন শরীরকে চাঙ্গা রাখে।

ইরি মৌসুমে চলনবিলের মানুষের অবসর যাপনের সুযোগ নেই। জমিতে ধানের চারা লাগানোর পর প্রতিনিয়ত জমিতে পানি সেচ দিতে হয়। স্যালো-ইঞ্জিনের দ্বারা কৃষক তার ধানের জমিতে পানি দেয়। এখন অনেক স্থানে বৈদ্যুত্যিক মোটর স্থাপনের কারণে কৃষকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। জমিতে আগাছা পরিষ্কার করা, সার দেওয়া ও পোকামাকড় প্রতিরোধ করে কৃষকরা তাদের ধানকে সতেজ করে রাখে। তখন চলনবিল যেন সবুজে ভরে ওঠে। ধানের জমি থেকে তুলনামুলক উচু জমিতে কৃষকরা বিভিন্ন ধরনের রবিশস্যের চাষাবাদ করে থাকে। যেমন- গম, ডাল, সরিষা, তিল। অনেকে শীতকালিন সবজি চাষ করে। শীতকালে কাঁচা সবজির ব্যাপক চাহিদা থাকায় গ্রাম পেরিয়ে সেসব শহরে চলে আসে। চলনবিলের উর্বর মাটিতে ধানের ফলন যেমন ভাল হয়, তেমনি আলু, পটল, পেঁয়াজ, রসুন, ধনেপাতার ফলনও আশানুরুপ হয়। কৃষির বৈচিত্র্যতা থাকার কারণে চলনবিলের মানুষ কৃষিজ পণ্যের অভাবে ভোগে না। চলনবিলের স্বাদু পানির মাছ আর জমির টাটকা সবজি দিয়ে রান্না করা তরকারির সাথে নতুন চালের ভাত খেলে কৃষকের যেন সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।

যখন ইরি ধান ঘরে ওঠে, তখন চলনবিলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত সময় কাটায়। কৃষকেরা ধান কেটে মহিষের গাড়িতে করে ধান এনে উঠানে নামায়। তাই গৃহিনীরা সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির উঠান গোবর-জল দিয়ে লেপে রোদে শুকিয়ে ঝকঝকে করে তোলে। সোলানী ধানের আঁটিতে উঠান ভরে ওঠে, সেই সাথে কৃষাণ-কৃষাণীর মনটাও সাফল্যে ভরে ওঠে। তারা স্বপ্ন দেখে- বছরটা এবার সুখেই যাবে।দিনের প্রথমভাগ জমিতে ধান কাটা হয় এবং বিকালে তা পা চালানো থ্রেসার দিয়ে মাড়াই করা হয়। বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার কারণে কৃষকের শ্রম একটু লাঘবের পথে। শ্রমিকরা ধান মাড়াই করে আর গলা ছেড়ে গান ধরে। মাঝেমাঝে সৃষ্টিকর্তার নামে জয়োধ্বনি দিয়ে আশ্বস্ততা প্রকাশ করে। ক্লান্ত শরীরে যখন দুর্দান্ত ঘাম ঝরে, তখন তারা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করে। শরীরের ক্লান্তি দূরীকরণে কাঁচা আম মাখানো খায়, বেলের শরবত খায় অথবা টকের আচার খায়। ধান মাড়ানোর পর ধান ও পোয়াল রোদে শুকানো হয়। সবাই মিলে ধান বাতাসে উড়িয়ে গুদামজাত ও বাজারজাত করে। সারা বছরের আহারের জন্য ধান সিদ্ধ করতে চাড়িতে ভিজিয়ে রাখে। শেষ রাতে উঠে তা সিদ্ধ করে রোদে শুকানো হয়। তারপর চাল বানানোর মধ্য দিয়ে কৃষকদের ধানের আবাদ নেওয়া শেষের দিকে চলে আসে। তাও শেষ হয় না। পোয়াল পালা দেওয়ার দিন ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন করে তবেই না ধানের আবাদের দিনগুলো শেষ হয়। অপরদিকে অন্যজেলায় থেকে আসা মহিষের গারোয়ানরা গাড়িভর্তি ধান নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করে। তাদের প্রত্যাশা, ‘আমরা আগামী বছর আবার আসব।

চলনবিলের মানুষের জীবন-জীবিকা ভারি বৈচিত্র্যময়। যাদের কৃষি জমি আছে, তারা কৃষি কাজ করে। কিন্তু যাদের বসতবাড়ি ছাড়া অন্য জমিজমা নাই তারা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। কেউ নদীতে নৌকা চালায়, কেউ বাজারে দোকানদারী করে, কেউ পরিবহনশ্রমিকসহ নানাবিধও পেশায় নিয়োজিত। বিভিন্ন পেশার সাথে সম্পৃক্ত থাকার মধ্যদিয়ে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা বজায় রেখে চলেছে। সামাজিকতার স্পর্শে সবাই যেন আন্তরিক। এ অঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান উদযাপনে তার উকৃষ্ট নমুনা পাওয়া যায়। পরিবার স্বচ্ছল হলে প্রতিবেশি কেউই যেন দাওয়াত থেকে বাদ পরে না। ধুমধাম করে সকল আয়োজন সম্পন্ন হয়। এলাকার মধ্যে বিয়ের আয়োজন হলে অনেকে গরুর গাড়ি, অনেকে স্যালো-নৌকা ব্যবহার করে থাকে। গান-বাজনায় বিয়ে বাড়ি মুখরিত হয়ে ওঠে। আনন্দ উদযাপনে চলনবিলবাসীর জুড়ি নাই। বিভিন্ন মেলা, নৌকা বাইচ, ঘৌড় দৌড়, পুজা-পার্বন ও খেলাধুলার আয়োজন যেন সকলের স্বচ্ছ বিনোদনের মাধ্যম। এসবের মধ্যদিয়ে চলনবিলের মানুষ তাদের অবসর যাপনকে প্রাণবন্ত করে রাখে।

চলনবিলাঞ্চলে উচ্চ ধনী যেমন রয়েছে, তেমনি দারিদ্রতা-ও রয়েছে। ঘরবাড়ির দিকে নজর দিলে তার প্রমাণ মেলে। কেউ কেউ ইটের দালান তুলেছে, কেউ কেউ দামি টিনের ঘর তুলেছে। দরিদ্ররা ছনবনের ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনেক সময় তারা জীবন জীবিকার তাগিদে শহরে পাড়ি জমায়। কিন্তু চলনবিলের মত অনুকূল পরিবেশ না থাকায় তারা আবার নাড়ির টানে ফিরে যায়। তখন তাদের মনে বিশ্বাস জাগে, ‘শরীর সুস্থ থাকলে এলাকাতেই ভাতের অভাব হবে না।যেহেতু চলনবিলে শ্রমের বৈচিত্র্যতা রয়েছে, সেহেতু দরিদ্রের কষাঘাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দুরুহ কিছু নয়। তবে সকলেই ভাগোন্নয়নের চেষ্টা চালায়, অনেক সময় পারিপাশ্বিক নানা কারণে জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে হয়। এটাই বাস্তবতা। চলনবিলের মানুষ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এখন শিক্ষিত হওয়ারও পথে। চলনবিলের অনেক গ্রাম আছে যেখানে শতভাগ লোক শিক্ষিত হয়েও কৃষি কাজ করে। চাকরির পেছনে না ছুটে পৌত্তিক সম্পত্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা এখন ভাগ্য গড়ার দিকে। এ অঞ্চলের অনেক কৃষকের সন্তানরা আজ দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় চাকরির পদে রয়েছে। অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবি, এমপি-মন্ত্রী রয়েছে। তারা সবাই গর্ব করে বলেন, ‘আমি চলনবিলের মানুষ, আমি একজন কৃষকের সন্তান

পরিশেষে বলা যেতে পারে, চলনলিাঞ্চল যেমন কৃষিজ, সজ উপযোগী এলাকা, তেমনি এলাকটি মানব সভ্যের জায়গা। মানুষে মানুষে বন্ধন এ এলাকার একটি উল্লেখযোগ্য ভাল দিক। হানাহানি নয়, সম্প্রতির বন্ধনে সবাই যেন জীবনকে চলনবিলের স্রােতের মত করে বাইয়ে চলেছে। নানা প্রতিকুলতাকে বির্সজন দিয়ে সভ্য জাতি হিসাবে বছর বছর ধরে চলনবিলবাসী জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। আমি চলনবিলের মানুষ হয়ে ভীষণ গর্বিত। আমি আমার চলনবিলকে হৃদয় থেকে ভালবাসি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট, ঢাকা।

No comments:

Post a Comment

International