বউ ও আমি....
ওয়াজেদ মিয়া
আমি ২০ বছর বয়সে বিয়ে করি। তখন আমার স্ত্রীর বয়স ছিল আমার বয়সের অর্ধেক। সে দেখতে অনেক সুন্দরী ছিল। আমাদের বিয়ের প্রথম রাতে আমার সাথে ফুলসজ্জার রাতে বিছানায় বসে সে অনেক কান্না করছিল। আমি যখন বিব্রতবোধ নিয়ে বললাম "প্লিজ,কান্না করো না" তখন সে কান্না থামিয়েছিল। এবং সাথে সাথেই আমাকে প্রশ্ন করে, "আপনি কি আমাকে একটা মেয়ে পুতুল কিনে দিবেন? আমি কাল ওর সাথে খেলবো।" তার প্রশ্ন শোনে কিছুক্ষন হাসলাম এবং তার কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম সে যা চায় আমি তাই'ই কিনে দিবো।
আমার মা অবশ্য তার বাচ্চাসুলভ আচরণ মোটেই পছন্দ করতেন না। আমার পরিবার বলত তাকে তার বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে। তাকে অনেক কঠিন কঠিন কাজ দিয়ে আমার মা তাকে শারীরিকভাবে অত্যাচার করতো। আমি তার কিছু কাজ গোপনে করে দিতাম। যেমন -রাতের আঁধারে পাশের পুকুর থেকে কাপড় ধুয়ে আনতাম যাতে কেউ বুঝতে না পারে। সে অনেক পরিশ্রমী ছিল, অবশ্য কান্ডজ্ঞানহীনও ছিল। এক সন্ধ্যায় দেখি সে সুপারি গাছে উঠছে, কারণ আমার মা পান খেতে চেয়েছিল আর ঘরে সুপারি ছিল না। দুর্ভাগ্যবশতভাবে সে পরে যায় আর মারাত্মক আঘাত পায়। আমি তার একমাত্র বন্ধু ছিলাম যার কাছে সে তার সব কষ্টের কথা শেয়ার করতে পারত। যখন তার পক্ষে কঠিন কাজগুলো করা সম্ভব হতো না, আমি চেষ্টা করতাম তার পাশে ছায়ার মতো থাকতে।
একদিন সন্ধ্যায় আমি গরু বাঁধছিলাম আর তাকে দেখছিলাম রান্নাঘরে রান্নার কাজে মাকে সাহায্য করছে। হঠাৎ করে আমাদের তেলের দোয়াত(বাতি) বিস্ফোরিত হয়। আমার মাকে আগুন থেকে বাঁচাতে মাকে জড়িয়ে ধরে দূরে ঠেলে দেয়। যদিও তার গায়ে আগুন লেগে যায়। এক সেকেন্ডের মধ্যে তার সারা গায়ে আগুন লেগে যায়। আমি দৌড়ে গেলাম এবং কোনকিছু চিন্তা না করেই আগুন লেগে যাওয়া শাড়িটা খুলতে লাগলাম। কিন্তু গরম তেল তার মুখে পড়েছিল এবং তার মুখ খুব খারাপভাবে ঝলসে যায়। হয়তো এটাই উপরওয়ালার সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিলো আমার জন্য। পরবর্তী ৯ মাস আমি রুমে দোয়াত জ্বালাইনি কারণ সে আগুন ভয় পেত। আমি রুম থেকে সব কাঁচের জিনিস সরিয়ে ফেললাম যাতে করে সে তাকে দেখতে না পায় এবং ভয় না পায়। আমি তার জামা পড়িয়ে দিতাম যাতে সে নিজের ত্বকে স্পর্শ না করে আর ত্বকে কোন ক্ষত না হয়। এক রাতে সে আমার হাত শক্ত করে ধরে বলেছিল, " আপনি কি আমাকে আগের মত ভালোবাসেন না কারণ আমি দেখতে বিশ্রী হয়ে গেছি?" আমি তখন কিছু বলতে পারিনি। শুধু আরও শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।
সে জানে না তার এই পোড়ামুখেও আমার কোন সমস্যা নেই কারণ তার কোমল হৃদয়টাকে আমি ভালোবাসি।
এই ঘটনার পরেও, সে দেখতে কুৎসিত এই কথা বলে আমার মা বলেছিল তাকে ছেড়ে দিতে। আমাদের বিয়ের ৫ বছর পরেও বাচ্চা হয়নি। তাই মা বলেছিল আমাকে আবার বিয়ে করাবে। এরকম অনেক অসহ্যকর যন্ত্রণা দিতে শুরু করে আমার মা। এসব সহ্য করতে না পেরে ৫০ বছর আগে আমার স্ত্রীর হাত ধরে, সবকিছু পিছনে ফেলে এই জায়গায় চলে আসি, এবং আমাদের সুখের পৃথিবী সাজাই। আমি আমার কথা রেখেছি। আমি সারাজীবন কাজ করেছি আমাদের সুখের জন্য। যদিও আমি ভালো গল্প বলতে পারতাম না, তবুও মাঝে মাঝেই তাকে একটার পর একটা কৌতুক শুনাতাম। আমি চাইতাম সে হাসুক। যখন সে হাসে তখন আমার মনে হত সবকিছুই ঠিক আছে।
আমার স্ত্রীর কন্ঠ অনেক সুমধুর ছিল। সে সবসময় আমার আশেপাশে গুন গুন করে গান গাইত। এখন আমার কথা বলার কেউ নেই। আমার অর্থহীন কৌতুক শোনার কেউ নেই। আমি যখন কাজ করি, তখন আমাকে গান শুনানোর কেউ নেই। এক রাতে আমাকে একা করে দিয়ে সে চলে যায়। মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে ঘুমের মাঝেই সে মারা যায়। ৫০ বছর পর আমার স্বপ্নভঙ্গ হল যখন সে আমাকে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা ফেলে চলে গেল। সে যতদিন ছিল আমার এক মুহুর্তের জন্যেও নিজেকে একা মনে হয় নি। আমি তার সাথে সারাজীবন থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তার মৃত্যুর পর এই পৃথিবী আমার কাছে মূল্যহীন মনে হয়।
No comments:
Post a Comment