মৃত নক্ষত্রের শহরে
রাহমান ওয়াহিদ
কবি রাহমান ওয়াহিদ। তাঁর মনন জুড়েই কবিতার বসত। ধ্যানী নিমগ্নতা তাঁকে ইতোমধ্যে ধ্র“পদ ধারার কবিদের কাতারে পৌঁছে দিয়েছে বলা যায়। নব্বই দশকের প্রথম ভাগেই তাঁর লেখালেখি শুরু হলেও প্রথম কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় শূন্য দশকের শেষার্ধে। এরপর তিনি আর থেমে থাকেন নি। একে একে সাতটি কবিতাগ্রন্থ এসেছে তাঁর হাত থেকে। রোমান্টিকতার পাশাপাশি চিরায়ত বাংলার মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি অপার ভালোবাসা তাঁর কবিতাকে দিয়েছে বিশুদ্ধ শিল্পের সুষমা। বিষয় বৈচিত্র্য, চিত্রকল্প ও উপমায় যেমন স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয়, তেমনি জীবনের নানান টানাপোড়েন ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার রূপায়নেও ফুটে উঠেছে শিল্পিত কারুকার্য। তাঁর কবিতাগুলো পড়তে কোথাও হোঁচট খেতে হয় না, একঘেঁয়েও মনে হয় না। এই বৈশিষ্ট্য কবি ও কবিতার প্রতি পাঠকের আগ্রহ বাড়ায়। নিঃসন্দেহে এ আগ্রহ বাড়াবে ‘মৃত নক্ষত্রের শহরে’ও।
কবিতাগুলোর রচনাকাল
[জানুয়ারী ২০১৪-জানুয়ারী ২০১৫]
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মৃত নক্ষত্রের শহরে
রাহমান ওয়াহিদ
প্রকাশকাল
প্রথম প্রকাশ: একুশে গ্রন্থমেলা ফেব্র“য়ারী, ২০১৫
প্রকাশক
কবি প্রকাশনী
৪৩ কনকর্ড এম্পোরিয়াম মার্কেট
২৫৩-২৫৪ এলিফ্যান্ট রোড কাঁটাবন ঢাকা-১২০৫
গ্রন্থস্বত্ব
লেখক
প্রচ্ছদ
ধ্রুব এষ
বর্ণবিন্যাস
মোঃ সেলিম রেজা
মুদ্রণ
কবি প্রিন্টার্স
৪৩ কনকর্ড এম্পোরিয়াম মার্কেট কাঁটাবন ঢাকা-১২০৫
ভারতে পরিবেশক
অভিযান পাবলিশার্স
৬৪/১ কলেজ স্ট্রিট কলকাতা ভারত
মূল্য: একশত টাকা
উৎসর্গ
‘ যে আমাকে দুঃখ দিল, যে যেন আজ সুখেই থাকে, সুখেই থাকে’
এমন জলজ হৃদয়েও যাঁর অনাদ্র সুখ ভাবনা
প্রিয় অগ্রজ কবি
মাকিদ হায়দার
যে কবিতা যে পৃষ্ঠায়
মৃত নক্ষত্রের শহরে ৯ মায়াবী শরীর ১০ শুন্যে মেলে দেব ধূপছায়া ১১ মানুষ ১২ নীল শাদা খামে ১৩ ছায়ারা হাঁটে ১৪ নিষিদ্ধ চৌকাঠে অকম্পিত লাশ ১৫ শাণিত পতাকা যখন ১৬ লাল সবুজের একাত্তর ১৭ আরণ্যিক কবোষ্ণ চোখে ১৮ মমি ও মর্মরিত ধ্বনি ১৯ জলশয্যার আকাল ২০ আয়ু অভিজ্ঞান ২১ ঘরেই পৃথিবী ২২ নদী যখন নাগরিক ড্রেন ২৩ দুঃখের ডানায় ২৪ যে দেশটা পুনর্বার আমাদের হলো ২৫ নীল দিঘি মন ২৬ অশঙ্ক কলধ্বনি ২৭ ঘাসবনে হলুদ অসুখ ২৮ দুর্বৃত্ত মেঘেদের নখরেও ২৯ রোদেলা জোছনায় ধুলিঝড় ৩০ ছায়ানীল বারান্দায় স্বপ্ন ঝালর ৩১ প্রিয় মতিহার: একটি অনুচ্চারিত পান্ডুলিপি ৩২-৩৩ ভাবুক বিড়াল ৩৪ বেভুল সময়ের নির্জনতা ৩৫ বৈপরীত্যে গল্পের অন্বেষা ৩৬ অনতিক্রান্ত অভিযাত্রার পাঠ ৩৭ অপূর্ণতার সপ্ত কাহন ৩৮ একটি অমুদ্রিত কথন ৩৯ ছাগল সমাচার ৪০ একটি তরল গদ্য ৪১ হৃদ বিদ্যা ও সুগার বিষয়ক ৪২ হেমন্তের কড়চা ৪৩ নৈঃশব্দের ক্ষরণ থেকে ৪৪ ভালোবাসাও পরেছে নূপুর ৪৫ বন্ধকী জমিন ৪৬ ঘাসগৃহে প্রান্তিক বিহঙ্গ ৪৭ ফেরারী গন্ধ ৪৮
রাহমান ওয়াহিদ
দেশ ও বিদেশের কিছু সাহিত্য পত্রিকা এবং স্থানীয় বিভিন্ন প্রধান প্রধান জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত লিখে লেখালেখির জগতে ইতোমধ্যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে পরিচিত হয়েছেন। লেখালেখির শুরুটা স্কুল জীবনে হলেও লেখায় সিরিয়াস হন মূলত চাকরি জীবনে এসে। জন্ম বগুড়ার নিভৃত এক গ্রামে। ছাপ্পান্ন’র সতের জানুয়ারি। কিন্তু গ্রামের শৈশবকাল পেরোনোর আগেই বাবার চাকরির সুবাদে তাকে চলে আসতে হয়েছে নগর জীবনে। বেড়ে উঠেছেন পাবনার রেল জংশনের শহর ঈশ্বরদীতে। মূলত কবি। তবে ছোটদের জন্যও লেখেন নিয়মিত। বাংলা সাহিত্যে একোত্তর এই লেখক সমকালীন কাব্যভাবনার সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছেন অনেকটা সফলভাবেই, যদিও ছাপার অক্ষরে তার গ্রন্থগুলো পাওয়া যায় বেশ কিছুটা দেরীতে।
প্রকাশিত গ্রন্থ
ক্স নীলজল সমুদ্দুরে যাবো (কবিতা গ্রন্থ ২০০৯)
ক্স অর্ধেক তুমি বাকিটা অন্য কেউ (কবিতা গ্রন্থ ২০১০)
ক্স শেকড়ে বকুলের গন্ধ (কবিতা গ্রন্থ ২০১১)
ক্স ভেঙে ভেঙে জেগে থাকে নদীর হৃদয় (কবিতা গ্রন্থ ২০১২)
ক্স পাগলা রাজার টেনশন (শিশুতোষ গ্রন্থ ২০১২)
ক্স পিকু ও পাখি (শিশুতোষ গ্রন্থ ২০১২)
ক্স ধুলো অক্ষরের চিঠি (কবিতা গ্রন্থ ২০১৩)
ক্স নীল ঝরণার দেশে (শিশুতোষ গ্রন্থ ২০১৩)
ক্স পিংকি ও একটি লাল গোলাপ (শিশুতোষ গ্রন্থ ২০১৪)
ক্স হঠাৎ দুরন্ত মুক্তি সেনা (শিশুতোষ গ্রন্থ ২০১৪)
ক্স গল্পগুলো ছোটদের (শিশুতোষ গ্রন্থ ২০১৪)
ক্স কেউ কখনো বাড়ি ফেরে না (কবিতা গ্রন্থ ২০১৪)
ক্স মৃত নক্ষত্রের শহরে (কবিতা গ্রন্থ ২০১৫)
ক্স ঘ্যাঁচাং ভূত (শিশুতোষ গ্রন্থ, প্রক্রিয়াধীন)
ক্স মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন এক রণাঙ্গনে (আত্মজৈবনিক উপন্যাস, প্রক্রিয়াধীন)
সম্মাননা
সত্যজিৎ রায় স্মৃতি পুরস্কার-২০১৩
E-mail: wahid1956@yahoo.com
মৃত নক্ষত্রের শহরে
কারো কারো চোখে প্রজাপতি বসলে কারো কারো চোখ থেকে পিঁপড়ের বিষ উপচে পড়ে-যেন দহনে কালো হোক প্রজাপতির পেলব ডানা। আমার পাঁজরের খোলেও এক আদিম জিঘাংসা কার যেন বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে আর ক্ষরিত রক্ত ঝরে জমাট বাঁধে আমারই হৃদপিন্ডে।
অথচ আমার জন্মই হয়েছিল কি চমৎকার পারিজাত বাগানে, আশ্বিনের জোনাকি সন্ধ্যায়, হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয়। এখন চারপাশের আয়নায় এত যে আলোর আলিম্পন- সেখানে মানুষেরই চেহারা নেই, নিজেকেও দেখি এক উদ্ভট ইতরের বাচ্চা যেন। একদা ভরাট জরায়ূ চিরেই তো সুন্দরের নগ্নতা দেখেছি আমি। তবুও কি করে যেন ভুলে যাচ্ছি শৈশবী সাঁতারি পুকুর, ভুলে যাচ্ছি রোদ জোছনার সমুদ্র বিহার, ভুলে যাচ্ছি হৃদিপদ্ম শিরিন- তোমাকেও।
এত বিষ, এত জিঘাংসা, এত বমন নিয়ে কি করে তাহলে বানাবো কবিতার প্রতিমা মুখ, কি করে বলবো যে, ভালবাসা তোমাকেও একটু নমিত হতে হবে মৃত নক্ষত্রের বিপন্ন এই শহরে।
মায়াবী শরীর
নির্জল ফেনায় ফেনায় উথাল নদী নামে বনে।
ক্লিন্ন চিলের ডানায় নেমে আসে সান্ধ্য বিকেল।
দূরাগত আগন্তুকের হাত থেকে খসে পড়ে কন্ঠহার ভালোবাসা।
অথচ কোথা থেকে আঁধার বয়ে আনে বাহুল্য বাদুড়
কোথা থেকে ক্রমশ: বেড়ে যেতে থাকে রক্ত ঋণের বোঝা
কোথা থেকে যে গড়িয়ে পড়ে বৃষ্টি শিশির কণা। জানি না।
অসুখের কণ্ঠ থেকে শুনে গেলাম অমিয় সুখদ বাণী
তবুও অশ্র“ত থেকে গেছে বিক্ষুদ্ধ ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি
নিস্তরঙ্গ থেকে উথলে উঠেছে কেবল বুকের বরষা আমার।
তবুও এই আমি এখনও শুধু মানুষের হাড় মাংশ নিয়ে
নিপুন ঢেকে রেখেছি দুধেল মায়াবী শরীর ও যমুনা-
যদিও মৃত্তিকার কাছে এখনো আমি কেবলি নির্বীজ শস্য কণা।
শূন্যে মেলে দেব ধূপছায়া রোদ্দুর
কী করে শূন্যে মেলে দেব ধূপ ছায়া রোদ্দুর
মৌনতা সুর ভাঁজে, নদীও ভিন্ন সাজে, দেখি যদ্দূর
বর্ষা ধোয়া সবুজের, আহা কি শান্ত সমুদ্দুর!
কে যাবে নীল ছাতা আকাশের ঢাকনায়
কে বলবে ‘এস, এই কাশবন কাহারবায়
মিশে যাই ঝিরিঝিরি বাতাসের মিহি গা’য়।
বৃক্ষ মেলার সাথে উড়ন্ত মেঘের খেলা
তোমার ওষ্ঠে তাহলে কিসের রহস্য দোলা
শীষ দেয়, যেন কেউ করোটি রেখেছে খোলা।
মানুষ
মানুষ উঠেছে, মানুষ ডুবেছে মানুষই পরেছে চন্দ্রহার
মানুষ জিতেছে, মানুষ ভেঙেছে, মানুষই খুলেছে সব দুয়ার।
মানুষ শুয়েছে, স্বপ্ন দেখেছে তারই খন্ডিত কন্ঠ নাল্
মানুষ ধরেছে, মানুষ কেঁদেছে, দেখেছে নিজেরই বুকটা লাল।
মানুষ ডেকেছে, মানুষ জেগেছে, বলেছে- ‘স্বপ্ন মাটিও চাই’
সেই মানুষই ক্ষীরের নহরে বলেছে ‘দুধে ননী পড়ে নাই’।
মানুষ তাহলে, মানুষ না হলে, মানুষের পাশে কেইবা শোয়
কোন্ সে মানুষ, মানুষের নামে নষ্ট বীজের পোশাক ধোয়?
নীল শাদা খামে
কে যেন বলেছে কানে কানে
বানভাসী মানুষের টানে
শরতের দেখা নেই কোন খানে।
অথচ কানে কানে কথা হয়
বাউরি বাতাসের সাথে বয়
কে যেন বলে কাহার সাথে
মাকড়সা হৃদয়ে মিশে নীল দুঃখ গাঁথে;
বিরহী রাখালিয়ার ডাকে
তবুও দু’হাত পেতে রাখে
শারদীয় ভালোবাসার হাতে।
দেখা নেই হয়তো বা শ্বাশ্বত ধামে
শরত এসেছে তবুও নীল শাদা খামে
মেঠো রোদে পুড়ে পুড়ে ভাদ্রের ঘামে।
হয়তো বা এইখানে নয়, রোদ শাদা কাশবনে
যেখানে শ্রান্ত নদীরা শুয়ে আগামীর ক্ষণ গণে
শরত নেমেছে ঠিকই সেই সব খানে
হয়তো বা শরতেরই ভিন্ন কোন নামে।
ছায়ারা হাঁটে
আমি হাঁটি না। আমার ছায়ারা হাঁটে
হেঁটে হেঁটে হিসেবের খেরোখাতা ঘাঁটে
আমি ডাকি না। আমার ছায়ারা ডাকে,
ডেকে ডেকে মাথা রাখে ঈশ্বরের নাকে।
আমার কোন তাড়াও নেই যে, যাবো।
আমার ছায়াদের বড় তাড়া।
তারা মরা বৃক্ষের মগডালে উঠে
আকাশের ম্যানহোলে ঢোকে।
আমি দুপুরের পায়ে নুপুর পরিয়ে
অখন্ড সবুজে দেখতে চেয়েছিলাম
তোমাকে। ছায়ারা যে তোমাকে দেখালো
তা আমারই ফেলে আসা-খন্ডিত পান্ডুলিপি।
এখন অভ্যেসটা এমন হয়েছে যে,
ঘুমে অঘুমে শুধু বেনামী ছায়াকেই দেখি
ছায়াকেই তোমার ভুল নাম ধরে ডাকি।
নিষিদ্ধ চৌকাঠে অকম্পিত লাশ
আকাশে ঝুলছে আকাশেরই শুন্যতা মেঘ।
রোদ বৃষ্টি ছাদে একলা পেয়ে যাচ্ছেতাই ভিজিয়ে দিলে
ধরে নিয়ো, এ তোমারই অশরীরী গল্পের পিছুটান।
গ্লাসের সঘন তরলে অভ্যস্থ চুমুক দিতে গেলে
টুপ্ টুপ্ ঝরে যায় যে রাতঘামের শিশির-
ধরে নিয়ো, তা তোমার নিঃশ্বাসেরই নিঃশব্দ ভাঙচুর।
এমত ছল্কে পড়া অসভ্য তরল গরল গড়িয়ে গড়িয়ে
নিষিদ্ধ চৌকাঠ পেরিয়ে গেলে
তুমি কুশলি হাতে থামিয়ে দিয়ো। (এ তুমি বেশ পারো)
তারপর দেখবে-সব কিছু নিথর, অকম্পিত লাশ-
ঠিক যেমনটি তুমি চেয়েছিলে-সেই বিপন্ন শুরুতেই।
শাণিত পতাকা যখন
মোহামুক্তির শাণিত পতাকা যখন হাতে হাতে
তরুণী জোছনা তখনও অরণ্য আড়ালে,
আগুন চোখা কালো কালো বিড়াল অন্ধকার
আচমকা ধেয়ে আসে, পতাকায় হিম রক্ত ঢালে।
উন্মাদ রণকৌশলে রক্তদানা ছড়াতে থাকে
সেই সব কর্পোরেট খাকি শুয়োরেরা
কলাবতী নারীদের জিহ্বায় লুকিয়ে রাখে
যেন বা শীতের সঞ্চয়, আহা, দিয়েছে পাহারা।
শেষ মেষ দেখাই তো গেল বেলা শেষে-অসহায়
গর্বিত তর্জনীর নমিত ভজন। শাণিত পতাকা তখন
শুয়োরী গন্ধ মুছে সূর্যøানের উন্মুখ প্রতীক্ষায়.....।
লাল সবুজের একাত্তর
(অনাগত প্রজন্মের উদ্দেশ্যে)
আমিও কখনো এমন শিমুল ঝরানো রক্তাভ একুশ দেখিনি
বজ্রের বিভাস দেখেছি শুধু মিছিলের প্রলম্বিত দৃশ্যপটে।
ছ’দফার কোন দফাই তো আমার বোধের আকরে ছিল না
শুধু জনতার সমুদ্দুরে দেখেছি ধূমায়িত বাষ্পের আশ্চর্য উদ্গীরণ।
এই যে সাতই মার্চ, কখনোই এমন তরঙ্গায়িত ফেনিল ছিল না
মুজিবের বজ্র ধ্বনিতে যেদিন অমর কাব্যটি আবৃত্ত হলো
সেদিনই সাত মার্চ ক্ষীপ্র অশ্বারোহীর ক্ষুরধারে স্ফুলিঙ্গ হলো।
এই একাত্তরও কখনো এমন অবিনাশী অহংকার ছিল কি?
দামাল রুমীরা যখন রক্তশিরায় বিষ্ফোরিত মুক্তিমন্ত্র ছড়ালো
সেই থেকেই একাত্তর এমন সঘন লাল সবুজে আবৃত হলো।
আরণ্যিক কবোষ্ণ চোখে
বিদীর্ণ রোদে শুকোচ্ছে ইচ্ছের পাথুরে ফসিল,
ভেতরে স্বপ্ননীল মাতামাতি। রংধনু নৌকার পালে
জোছনা মাখা ছায়া বন্ধ্যা জমিনের মতো নির্জীব
শুয়ে আছে একা, যেন বা কুলভ্রষ্টা মৌনি এক নারী।
আরণ্যিক কবোষ্ণ চোখে যে মায়াবী দ্যূতি, তাতেও
লৌকিকতার ঘোলা জল, নগ্ন ক্ষুধা আর রক্ত মাটির
নিঃসঙ্গ চিৎকার। কোন আঁধারেই অপেক্ষার জোনাকি নেই।
দেখি শুধু ভুলিয়ে রাখার শতেক বাহুল্য প্রকার।
মমি ও মর্মরিত ধ্বনি
শিল্পী, তুমি দারুণ আঁকো,নিখুঁত পরিপক্কতায় ।
মুজিবের ধূমায়িত পাইপের দ্রোহী উ˜্গীরণ
নূর হোসেনের অবিস্মরণীয় খোলা বুক বিস্ফোরণ
এমন কি মোনালিসা হাসির অবাক সিম্ফনিও
তোমার রঙতুলিতে নিখুঁত মূর্ত হয়ে ওঠে,যেন
তুমিই সদ্য জেগে ওঠা পিকাসো,অনন্য কাইয়ুম ।
সেই তোমার রঙতুলিটা এমন বিবর্ণ,ডিম শাদা কেন ?
আমার মুখের ফ্রিকোয়েন্ট বিবর্তনে বিব্রত কি তুমি ?
ধরতেই পারছো না চেহারাটার মমি ও মর্মরিত ধ্বনি ।
এখন যে আদলে দেখছো শূয়োরের অনিন্দ্য মুখ
তাকে আঁকতে গিয়েও আশ্চর্য খাবি খাচ্ছো তুমি !
তারচেয়ে বরং রোমকূপ থেকে তিরতির বেরিয়ে আসছে যে
ভালোবাসার ঘাম ঘাম শিশির ধোঁয়া-
তাকেই সযতেœ আঁকো হে সুপ্রিয় শিল্পী আমার ।
দেখেছো ?তোমার তুলিটা এখন শিল্পিত রংধনু হয়ে
ক্যানভাসের সীমানা ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে চলে যাচ্ছে
ভিন্ন এক অববাহিকায়,ফেনায়িত জলের দিকে....।
তুমি বরং ক্ষান্ত হও হে বরেণ্য। ভীষণ ক্লান্ত তুমি এখন ।
জলশয্যার আকাল
আত্মমন্থনের মতো শব্দগুচ্ছের বড় আকাল
এই ধ্র“পদী শহরে এখন।
শব্দ খেলুড়েদের আজন্ম তৃষ্ণা মেটাতে
প্রয়োজন যখন জলজ প্রকৃতি ও নারীর
জুয়ারী আসরে তখন কবিতার অলংকারে
আজগুবি গপ্প সাজায়
কিছু জন্মান্ধ পোশাকি কলম।
অদ্ভুত এক বর্ণ বিণ্যাসে
আঁচড় পড়ে শ্বাশ্বত বিশ্বাসে
কে যে শোয় কার শরীর ঘেঁষে
কবিতা বিমূঢ় তখনও
সেইসব ঘন নিঃশ্বাসে।
চাঁদের চাদরে, কুমারী মেঘের জলে
উপমার নন্দিত নগ্নতায় সেইসব পোশাকিরা
শব্দ আঁকে বিপন্ন মগ্নতায়।
কবিতার ভীড়ে নির্জীব পড়ে থাকে, হায়
চিত্রকল্পের কাঠ কংকাল-
কেই বা জানতো এমন শহরে
নিমজ্জিত হবার মতো জলশয্যার
এত যে আকাল!
আয়ু অভিজ্ঞান
এক বিষন্ন সকালে দিঘিনালায় ভেসে উঠতে লাগলো শত মৃত
কচ্ছপের লাশ। তাদের কারোরই বয়স নাকি দেড়শ’ বছরও
পেরোয়নি। আত্মহননের মতো কিছু কি? সম্প্রতি কচ্ছপের
অতিদীর্ঘ বাঁচা নিয়ে ঢের প্রশ্ন উঠেছিল। সৃষ্টির সেরা মানুষের
আয়ু কেন স্বপ্নের চেয়েও ছোট? তা নিয়েও আক্ষেপের শেষ
ছিল না অনেকেরই।
বিচলিত জ্যান্ত কচ্ছপেরা, আশাবাদী আয়ুষ্কামীরা একটা যৌথ
সভা থেকে প্রস্তাব পাঠালো ঈশ্বরের কাছে। কচ্ছপেরা এখন
নাকি মানবিক আবেদনে ছেড়ে দিতে রাজি দেড়শ’ বছর। সেই
দেড় শ’ বছর কি তবে পেয়ে যাবে আয়ুষ্কামী মানুষেরা?
মেলেনি উত্তর। প্রশ্নটি ঝিমোচ্ছে এখনও সিদ্ধান্তের বারান্দায়।
ঈশ্বরের আয়ু বিশেষজ্ঞগণ হিসেব-নিকেশে গলদঘর্ম চিন্তিতও,
কচ্ছপের লম্বা আয়ুটি হিসেবের কোন ভুলটুল নয় তো? এর
চেয়েও দূর্ভাবনা তাদের, বর্ধিত আয়ু পেলে চতুর মানুষেরা
ঈশ্বরের অমরত্বই চেয়ে বসবে কিনা। তবে আপাতত তারা
স্বস্তিতে এই ভেবে যে, ঈশ্বরের ভাতঘুম ভাঙতেই কেটে যাবে
অন্তত দেড়শ’ বছর।
ঘরেই পৃথিবী
যাই না কোথাও। গন্তব্যহীন যেতে যেতে নিজের
ঘরেই কড়া নেড়েছি আটষট্টি বার। শেষ মেষ ঘরকেই
পৃথিবী বানাই। ঘরের ভেতরে শত শত ঘর। এ ঘর
থেকে ও ঘরে যাই। হাত রাখি তানপুরায়। শিশিরের
গন্ধ মাখি গায়।
খুব করে যেতে বলেছিল উল্লাপাড়ার জয়নাল, শিবগঞ্জের
বিলকিসও-। ওদের ঘরহীন ঘর যেন দেখে আসি একটি
বার। বলেছিলাম-যাব। হয়ে ওঠেনি আর। ঘরেই তো
পৃথিবী। কখনো জানালার পর্দা ছিঁড়ি, নিঃশব্দের বানান
শিখি, আর সংসারের দূর্বোধ্য নামতা পড়ি।
নদী যখন নাগরিক ড্রেন
এখানে নদীদের স্বভাব বড় অন্যরকম। ভাঙে না। গড়ে না।
খিদে পেলে বালি খায়। নিরামিষ বর্জ্য খায়। খেতে খেতে
হাঁটুজল খাল খায়। নাগরিক ড্রেন হয় শেষমেশ পয়:নিষ্কাশন।
এ বড় অদ্ভুদ নগরী। চোখ ধাঁধানো ঘরবাড়ি। কে যে মালিক তা কেউ
জানে না। মাইনে করা প্রহরী থাকে না। সংসার পেতে অথবা না
পেতেও রং এর কলস শুন্য করে যে কেউ যেতে পারে আদিম øানে।
রাস্তাগুলোও আশ্চর্য মসৃণ বেডের মতো শুয়ে আছে পথে
যন্ত্রের তান্ডব নেই, শাঁ শাঁ যেতে পারে যে কোন গঞ্জে বা শহরে
গায়ে গা লাগিয়ে নির্বিঘেœ হেঁটে যায় সুগন্ধি নারী ও ঘা গন্ধ কুকুর।
পাল্টানো চোখের মানুষের ভিড়ে চেনে না কেউই কারো চক্ষু কোটর
দৃষ্টির ভেতরে জ্বলে স্বপ্নের নক্ষত্র, আগ্রাসী ক্ষুধা আর জীর্ণ সভ্যতা
মাটিতে পড়ে থেকে হু হু কাঁদে শুধু সৌকর্যহীন ভিখেরী গ্রাম্যতা।
দুঃখের ডানায়
দুঃখ বসে ছবি আঁকে কদমতলায়
শতেক গজ দূরেই দুটি সবুজ জানালা।
একটি জানালা খুলে যায় ঠোঁটের মতো
দু’ভাগ হয়ে। তখন দুটি তারা জ্বলে ওঠে।
সন্ধ্যের বয়স বাড়ে, নামে রাত
জানালাটিও বন্ধ হঠাৎ। মুহূর্ত যায় গলে
কিন্তু হাজারটি তারা দুঃখের ডানায়
জোনাকীর মতো নেভে আর জ্বলে ।
যে দেশটা পুনর্বার আমাদের হলো
আমরা তো আমাদেরই ছিলাম, আর যেমনটা ছিল সবাই। এই তামাটে মাটিও আমাদেরই ছিল, পুনর্বার আমাদের হওয়ার আগেই। সে গল্প ছিল বহুযুগ আগের। সুপুরুষ পিতামহও জানতেন। শুধু জানতেন না মামুলি ভূমি চাষ। শহুরে পিতামহী তাঁর ছায়া ধরে ধরে হাঁটতেন, সেখানেই ছিল তার যাবতীয় চাষবাস। ভূমি চাষ আটকায় নি তাতে। কিন্তু আটকে গেলেন তিনি অন্য এক চাষে
যৌবনের যুদ্ধটা তো চাষেরই। কামান বারুদের ধোঁয়াশে হলকায় নির্জীব মানুষেরা যখন টপাটপ ডুবে যাচ্ছে মাছেদের পুকুরে, পিতামহ এক ঝটকায় ছিঁড়ে ফেললেন পাঞ্জাবীর সবুজ, এক টানে ছিঁড়ে ফেললেন পিতামহীর লালঠোঁট ব্লাউজ, আর টুকরো সবুজের ওপর বসিয়ে দিলেন লালটিপের গোলাপ। তারপর বাঁশের ডগায় সেই দু’রঙা কাপড় উড়িয়ে ছুটলেন গ্রাম থেকে গ্রামে, শহর থেকে গঞ্জে, জনপদ থেকে প্রান্তিক জনারণ্যে-গলা ফাটিয়ে বললেন- কেন এই যুদ্ধ? তোমরা কেন এই ডালভাত শালিকের বাংলায়? হঠ্ যাও, হঠ্ যাও। এ আমাদেরই রক্তমাংশের মাটি ও শরীর’................।
চিৎকার থামতে না থামতেই নাদুশ শরীরটা নিমেষে ফুটো হলো। সৌখিন পিতামহ মিশে গেলেন লালপানি মাছেদের ভীড়ে। দেশটা আমাদেরই ছিল, পুনর্বার আমাদেরই হলো।
নীল দিঘি মন
ইকারুসের ডানায় আকাশেতে উড়ি
খুঁজে ফিরি প্রেয়সির নীলদিঘি মন
নীলগিরি চুড়ায়ও ব্যর্থ আরোহন
দুঃখের অনল হৃদে হিমজলে পুড়ি।
ভাবনায় দেই সাড়া পাহাড়ের ডাকে
নদী হয়ে ছুটে চলি সাগরের বুকে
যদি পাই তার দেখা ঝিনুকের মুখে
হাঁসুলি সুতোয় বেঁধে রাখবই তাকে।
নীলদিঘি মন পেতে হই চণ্ডিদাস!
রজকিনীর অপেক্ষায় বড়শি হাতে
ঘাটের কিনারে বসে ফেলে দীর্ঘশ্বাস
জলের শরীর চুমি মেঘবতী রাতে।
হবে না বন্ধ কখনো দখিনা দুয়ার
ছন্দোব্রত পাখি আমি সাড়া জাগাবার।
অশঙ্ক কলধ্বনি
আমি কোন শীতে জবুথবু
নির্মোক উচ্চারণের কথা বলছি না।
কোন নির্মোহ চোখের পলকহীনতায়েও
ভুলে যাচ্ছি না জীবনের ঋদ্ধ শে¬াক।
শুধু কিছু অনুচ্চারিত সলজ্জ শব্দকে
ভেঙেচুরে, উল্টেপাল্টে দেখতে চাইছি-
প্রায় অপাংক্তেয় কিছু প্রমিত অক্ষরের
সঘন সম্মিলন
কোন একটি নান্দনিক উচ্চারণের
ঋজু বাহন হয়ে উঠতে পারে কিনা। এবং যদি
তেমনটি ঘটেই যায়, তাহলে তা যেন
কোন দৈবিক কন্ঠে অশঙ্ক কলধ্বনি হয়ে ওঠে
এবং সে কন্ঠটি যেন হয় ক্লেদ আকীর্ণ
এই আমাদের, সবার।...
ঘাসবনে হলুদ অসুখ
যাচ্ছি, হয়তো বা যাচ্ছি না, পা চলছে টলমল
যে ঘাসবনে জিরোবো ভেবেছি, তার ডগায় হলুদ অসুখ।
পথগুলো পথে নেই, প্রান্তে ঝোলে দুধেল হাওয়া
এমত উজানেও ভাটার ঘন সংকেত, যাবে তুমি? ভাবো।
রাতের ট্রেনটি ফাটা বাঁশের ফাঁদে সুতীব্র কাতরায়
বজ্রের দাপটে সন্ত্রস্থ কোমল নদী, জলবস্ত্র হারা।
আমি পদ্মাজলে হেঁটে হেঁটে ফুরোচ্ছি আয়ূ অনর্থক
তুমি কোন্ ভরা গাঙে পান্সি ভাসাবে-তুমিই ভাবো।
আকাশে নিয়ন বাতি, ট্রাফিকের সান্ধ্য বিলাস
বোশেখেই জলের মেয়েরা দেখি মাছের শরীরে ভাসে
দয়িতার বুক পেটে পেরেকটি ঠুকেই ভেবেছিলাম-যাবো,
পথে দেখি পথ নেই, শুয়ে আছে বাদুড় ছায়া, ঘাসে।
দুর্বৃত্ত মেঘেদের নখরেও
খুব একা লাগে - যখন
নষ্টামি আর জ্যোতির্ময় উচ্চারণগুলো
বিনম্র সঙ্গীতের বিবাগী স¦রলিপি হয়ে ওঠে।
খুব অবাক লাগে - যখন
পতিত শস্য দানার সাথে পলিজ মৃত্তিকাকে
বেমালুম গুলিয়ে ফ্যালো দুর্বোধ্য রসায়নে।
খুব বিষন্ন লাগে - যখন
নষ্ট ভ্রণের জিহ্বায় নবজাতকের অবিমিশ্র চিৎকার শোন।
অথচ খুব আমোদ হতো - যদি বলতে
আসন্ন বর্ষায় আমরা শ্রাবণ প্রসবিত ভিজে গন্ধ হবো।
খুব প্রসন্ন হওয়া যেতো - যদি বলতে
এই অখন্ড একাকিত্ব একদিন শতমুখ জনারণ্য হবে।
সুখ নিদ্রায়ও ডুবে যাওয়া যেতো - যদি বলতে
এই ঝুলন্ত আকাশও প্রফুল¬ জলছাদ হবে
দুর্বৃত্ত মেঘেদের ধারালো নখরেও।
রোদেলা জোছনায় ধুলিঝড়
যূথবদ্ধ কথারা আসছে কেটে কেটে
নেটওয়ার্কে মাকড়সা, বেরঙা আকাশ।
জমাট মেঘবালা ছিঁড়ে নামছে, দ্যাখো-
আষাঢ়-শ্রাবণে বোশেখী বজ্রহাত।
ভালোবাসা, তুমিও আসছো কেটে কেটে-
হৃদিপদ্মে বি¯তৃত সজারু ধূম্রজাল।
রোদেলা জোছনায় দেখি ধোঁয়াশা, ধুলিঝড়
কেটে কেটে আসছো কি তুমিও, সকাল?
ছায়ানীল বারান্দায় স্বপ্ন ঝালর
পুরু লেন্সেও ধরা পড়ে না ঔশ্বর্য্য পলল
গড়াগড়ি খায় বিবমিষা, পতিত গরল
বিচূর্ণ ভূমিতলে ভেজে নদী কাদাজল।
শিয়রে দাঁড়ানো ঘোলাচোখ পাল্কিবাহক
কে বা তার সোয়ারী- কিইবা কুহক
কাকে তুলে নেবে, হায়, জানে না তা কেউ
জলে ভেসে যায় শুধু আতরের ঢেউ।
দেখি না, দেখি না তবুও দেখে যাই
অরণ্য দুপুর, নাকি সন্ধ্যের ভাই
রাতের বোনেরা তবে কেন আসে নাই?
স্ফিত হতে থাকে ফের আকাশ কুসুম
জলডাঙ্গা গ্রাম দোলে ডাহুকের কোলে,
ছায়ানীল বারান্দায়, আহা, কি দারুণ-
কাঁচ ভাঙ্গা স্বপ্নের ঝালর ঝোলে।
প্রিয় মতিহার: এক অনুচ্চারিত পান্ডুলিপি
(রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থ বন্ধুদের উদ্দেশ্যে)
পদ্মাপাড়ের প্রিয় মতিহার-যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে
অনুচ্চারিত পান্ডুলিপি হয়ে। নির্বাক আম্রকানন, যার
ছায়ায় ছায়ায় মিশে আছে বাদামের বাদামী খোসারা,
ঝালমুড়ি, চানাচুর, পোড়া সিগ্রেটের বিচূর্ণ ধোঁয়া।
মিশে আছে যে ঝরাপাতার ভাঁজে ভাঁজে অজস্র কথার
বিনুনি আর কলকল পদ্মার হিম বেদনা-
সেইসব এখন কেবলি নৈ:শব্দের মৃত পদাবলী।
জমাট স্মৃতির এমন অনাদ্র বারান্দায় অবিশ্রান্ত হেঁটে হেঁটে-
কাকে স্পর্শ করবে হে প্রিয় বন্ধুরা আমার? কাকে?
০২.
হয়তো বা জানো না প্রিয় বান্ধবী রীনার সিম্ফনি হাসিটি
সেই কবে থেকে কবরের হলদে প্রজাপতি হয়ে নাচে
মটু মঞ্জু তারও আগে পতিত নক্ষত্রের মতো শায়িত একাকী।
প্রিয় পরিমল আইভি’র সমুদ্র চোখে দক্ষ সাঁতারু হয়েও
কোথায় যে তলিয়ে গ্যালো, কেই বা জানে তা।
কে যে কোথায় কার পাশে শোয়, কে বা হারিয়ে বসে আছে
স্মৃতির মিনার, জানি না জানি না সেই সব ধূসর বারতা কোনো।
শুধু টের পাই, যে পথেই চলি- তোমরাও চলো আমার পাঁজর
ছুঁয়ে ছুঁয়ে, শুনি ক্যাফেটেরিয়ার আনন্দ কলতান।
০৩.
কে বা কারে মনে রাখে, কেইবা কারে ডাকে, তবুও ইথারে
খবর আসে এ কান সে কান হয়ে এইসব ছিন্ন অক্ষরে।
সিলেটি হান্নানের মহাজনী বই এর স্তুপে মতিহারের
একটি ঘাসফুলও নাকি ফোটে নাকো আর।
জামিলের নাদুশ শরীরে গল্পের যে অথৈ ক্ষীর জমেছে-
তার সবটাই হিসেবী বচন কথন, নেই মতিহার।
জয়নালের ধোপদুরস্ত ক্যাডেট চেয়ারে মন জাগানিয়া
কোন পিঁপড়েও নাকি বসে নাকো আর ক্লান্ত হয়ে।
রাশীদের হামদহে কোন রাশীদ কি থাকে আর?
যে থাকে সে কেবলি শাদা কালো কোন এক দীর্ঘ মানুষ।
সীমার হাত ধরে যে দিলরুবা মিজু নিজেরে হারিয়ে
খুঁজেছিল বিরল ঝিনুক, সে নাকি আজো জানেই না
কি তার চাওয়ার ছিল, অথবা ছিল না কখনোই।
০৪.
প্রিয় সব স্যারেরা ক্লান্তিতে ডুবে ডুবে কোথায় হারিয়ে গেলেন
কলাভবনের মুখরিত কূজন ছেড়ে?
জীবনানন্দীয় উদাসী আসাদুজ্জামান স্যার পাখিনীড় খুঁজতে গিয়ে
সেই যে দিগন্তে মিশে গেলেন, এলেন না ফিরে আর।
চৌকষ শেখ আতা স্যার পুরু লেন্সের চশমায়
এখনও কি দারুণ রোমান্টিক তারুণ্য প্রতীক? নাকি তিনিও...
সফেদ পাঞ্জাবীর আবু তালেব, মোল্লা স্যার কি শেষতক্ পাঞ্জাবীর কাফনেই
জড়িয়ে গেলেন? ছন্দের ব্যাকরণ পড়াতে পড়াতে যে আবু বকর সিদ্দিক স্যার
নিজেই জ্যান্ত কবিতা হয়ে উঠতেন, শুনেছি তিনি নাকি খুলনায় নিজেই
নির্জনতার কবর খুঁড়ে রেখেছেন, সেখানেই শোবেন বলে।
০৫.
কোন বন্ধনের সুতোও কি খুঁজে পাওয়া যাবে আজ শহীদ মিনারে
কিংবা প্যারাডাইস রোডের অবিনাশী মশৃনতায়? কোন মুক্তা, কোন সাত্তার
কোন মান্নান, কোন রেজা, কোন ফিরোজা, কোন বিলকিস বা কোন লিলি
আচমকা বলবে কি ডেকে- ‘চল রে যাই, হৃদয়ের কোমল পাদদেশে,
বসি একটু খানি’? চাইবে কি হৃদয় খুঁড়ে সুখদ বেদনা জাগাতে?
অথচ নিস্তব্ধ লাইব্রেরীতে নির্বাক বইয়ের সারিতে সশব্দ কথারা আজো
থই থই খেলা করে। ক্লাসের টেবিলে গোপনে চিরকুট লেখালেখি ও পাচার
এখনও চলে- শুধু আমরাই লিখে যাই অন্য সব কথা
অন্য সব বিষয়-অবিষয়- সংসারের বশংবদ মাথাটি হাঁটুতে গুঁজে।
ভাবুক বিড়াল
না হয় শূন্যই থেকে যাক্ এ দুটি হাত, যেহেতু খেলে না এখন আর নাচুনে মুদ্রা কোনো। দু’কলস ভরা যে কোমল নদী ছিল- এক পোড়ামুখীর বুভুক্ষু চোখে তা ঢেলে দিতে হলো। সকাতর কিশোরী এক বুকের বেলুন খুলে এসে দাঁড়ালো যখন তোমারই মতো করে- তাকেও ভরিয়ে দিতে হলো শীতোষ্ণ হাওয়ায়। পাঁজরের কূয়োতলায় জন্মেছিল যে ভ্রমণের ঝাউবন-এক নীলাভ নারীর বিমল কান্তিতে, তা-ও..। এখন দু’হাতের তালুতে কেবলি ঘুমায় এক ভাবুক বিড়াল।
বেভুল সময়ের নির্জনতা
কেউ একজন গুছিয়ে দিচ্ছে সুটকেসে
জামা-কাপড়, টুথব্রাশ, প্রয়োজনীয় ওষুধ-বিষুদ
গুছিয়ে দিচ্ছে শয্যা ও বালিশ, এলোমেলো শব্দগুচ্ছ,
বেভুল সময়ের নির্জনতা, বেলুনের ব্যর্থ বাতাস।
পড়ে নেই কোথাও পোড়া রোদ, পাড় ভাঙ্গা নদী,
মিহি কাঁচা জোছনা, ট্রেনের আর্ত হুইসেল।
শুধু শরীর থেকে নিঃশব্দে নেমে যাচেছ যে
মায়াবী অসুখ-বিসুখ, বেহুদা দুঃখের পলিজ বসতি
বিমূর্ত ভালোবাসার মাকড়সা জাল ও সূতো-
কোন সুটকেসেই বন্দী করা যাচ্ছে না সেইসব, যাচ্ছে না।
বৈপরীত্যে গল্পের অন্বেষা
ঘুম স্বপ্ন থেকে স্বপ্ন ঘুমে যেতে যেতে
ঘুমহীন এক অলীক অলিন্দে থমকে দাঁড়াই।
কামজ প্রেম থেকে মানবিক বৃক্ষে যেতেও
বিনম্র নগ্নতায় ডুবে থাকে মল্লারী মগ্নতা।
এইসব বৈপরীত্য নিয়েই যাপিত জীবনে
আসে প্রণয়ান্ধ নারী, আসে বর্জ্য শরীর
আসে বসন্ত ছেনে আশ্চর্য বর্ষা দুপুর!
মূলতঃ বেলা অবেলায় বিভ্রমী রাত সকালে
সুখদ গল্পেরই অন্বেষা চলে,
শিল্পিত কথকথার নামে-
ডাকে অন্ধ কোকিল, নাচে কাক পক্ষি ময়ূরী কোন।
অনতিক্রান্ত অভিযাত্রার পাঠ
বিরহী রাতের মিহি-স্তব্ধতাকে ছুঁতে গিয়ে তোমার
স্বপ্ন মেঘের কালো খোপাটি অনিচ্ছুক ছুঁয়ে ফেলেছি।
গাংচিল মনটাতে শৈশবী সাপবেলুন ওড়াতে গিয়ে
অনস্পর্শি তোমাকেই বনান্তরে বেমালুম উড়িয়ে দিয়েছি।
আরো কি আশ্চর্য দ্যাখো-
প্রাকৃতিক অবরুদ্ধতার দুয়ার না খুলেই
গোপন অলংকারের মতো একটু একটু করে
যাচ্ছেতাই খুলে ফেলেছি তোমাকেই।
অথচ তোমার সলাজ শরীরে এমত পরিভ্রমন
মানেই জলে ভাসা খড়কূটো, অসাড় নিস্পন্দ পদ্ম শিশির।
বুঝি না আমার প্রাচীন কংকালে ঘাপটি মেরে বসে
কে শেখায় এমন দুর্বৃত্ত পাখিদের অনতিক্রান্ত অভিযাত্রার পাঠ?
অপূর্ণতার সপ্ত কাহন
পূর্ণতা তো শূন্যতারই ভরা পেট।
এমত পূর্ণতায় যাবো বলেই
পাথুরে পাহাড় কেটে কেটে পথে নেমেছি।
বিমূর্ত জোছ্না জলে পুরো আকাশ নামাবো বলে
ছায়াপথ ধরে ধরে এতটা হেঁটে এসেছি।
এখন তোমাদেরই দেখি ফাটাবুক হা পিত্যেশ
ঐশি হাওয়ায় ভাসে নাকি বেনামী অনির্দেশ
এই যদি হয় পূর্ণতার নামে শূন্যতারই সপ্ত কাহন
নামুক না তবে অসূর তান্ডবে বৃষ্টি ও দাহন।
একটি অমুদ্রিত কথন
আকাশের ছায়া তলে নয়, দিঘিনীল সন্ধ্যায় নয়,
চলিষ্ণু মহাকাল থেকে ভেসে আসা মগ্ন আবাহনে
কিন্নরী পানসি ভাসাবো ঠিক কোন এক আতসি দিনে।
হায়রে-
কেইবা বলেছে- আয়রে স্বজন সজল অতলে আয়
অরক্ষিত নারীও তো বলে নাই- ডুবে থাকো কৃষ্ণ ও রাধায়
পরিযায়ী পাখিরাও কি বলেছে- ওই যে অসীমের গান শোনা যায়?
আসলে-
কেইবা জানে-শরীরে আমার কত যে বর্জ্য আর নোনাজল জমেছে
কেইবা জানে-এই হৃদি পদ্মে কত যে নারী লাল টিপ আঁচিল ছিঁড়েছে
কেইবা জানে দু’পায়ে আমার কত যে না ছোঁয়া পথের দূরত্ব বেড়েছে।
অথচ-
কারো না কারো বলার কথা ছিল-এসো এই স্তনগুচ্ছ নিপবনে এসো
কারো না কারো বলার কথা ছিল-শীতের জীর্ণতার সাথে বাসন্তি ওমও দেব
কারো না কারো বলার কথা ছিল-ভেঙ্গে যাওয়া হাটেও দেয়া যাবে মৃদঙ্গ উৎসব।
তাহলে-
অসীমের গহ্বরে তলিয়ে দিতে ভাসুক না শরাবী মদির রঙিন
বাধাই বা হবে কিসে মৃত্যুরে সাথে লয়ে যেতে কোন একদিন।
ছাগল সমাচার
ধরিই তো ছিলাম বাহে, কিন্তুক গ্যালো যে কুথায়
‘ক্যামোন করি ধর গো বাহে যে ফোসকি যায়!’
আসলেই তাই। কিন্তুক সে কথা তো কহিবারও নয়।
বরশিতে যে মাছটি আধার ধরি রেখিছিল
সেও বড় চালাকি জানে গো। টান মারতিই হাওয়া।
‘না গো বাহে না, মাছের অতো বুদ্ধি সুদ্ধি নাই
তুমিই আসলে বোঝ নাই- মাছের কেমুন খাওয়া।’
মানুষই কি বোঝে এখনও- দিবস অথবা রাতি?
কেউ কি গোণে-ক’টা গেল সাদা হাঁস, ক’টা গেল হাতি?
‘গরু মারিয়া ছাগোল ক্যান্ দ্যাখাইতেছেন বাহে?
এ্যাতো ছাগোল তো আছিলো না এই দ্যাশ গাঁয়ে!’
একটি তরল গদ্য
এই গদ্য কথনটির বয়ান আমার মুখে সাজেনা। আমি মুখ্যু সুখ্যু। খাওনের দানা ফলাই। বউরে সাজাই। বছর অন্তর বাচ্চা দেই। বড়ই সুখ। ডাগর মাইয়ারা ক্যান জানি আমার সুখে খালি হাসে আর ডাকে। আমি যাই না। যামু ক্যান? আমি কি রতন ঘরামি নাকি? রতনটা কেমুন য্যানো। কাউরে মান্যি গণ্যি করে না। তবুও তাহার কথাটি বলিতে খুব সাধ হইতেছে। রতন ঘরামির ঘরখানা যেমুন, বউও আছিলো তেমুনি। বড়ই সোন্দর। সেই রতন এক জাউরা পোলার মা’র খাওন দেখিয়াই তাহার মাথায় আগুন উঠিল। (আহা! জাউরার জন্য কি দরদ!) দিলো পাছায় দুই খান লাত্থি মোড়ল বুইড়াটাকে। ইহা কি কোন জায়েজ কাম হইলো? কিন্তু রতনের সোজা কথা, ‘লাত্থি মারাটা ফরজ আছিলো।’ কিন্তু ফরজ কামের মাজুনডা যে কেমুন-রতন তো তাহা জানিতো না। তাই যাহা হইবার তাহাই হইলো। তাহার পূর্ণিমা ঘরে কৃষ্ণপক্ষ নামিল। অসূর নামিল। বজ্র নামিল। আর বউটির নাভীতলে কত তরল সীসাই না ঝরিয়া পড়িল। আহা! এমত বয়ানে চক্ষু ভরিয়া জল আসিয়া পড়ে। কিন্তু পোড়া কপাল্লি¬য়া রতন কয় কি জানেন? কহিল, ‘যাউক গা। রতন কাউরে ডরায় না।’ হায় আল্ল¬াহ্, কয় কি শয়তানডা? তাজ্জবের কথা বার্তা! তো রতন ঘরামির আবারো ঘর উঠিল। পূর্ণিমা ভাসিল। দুধেল শাদা বউ আসিলো। তা আসিলে কি হইবে- বউ এর তলপ্যাট তো আর রতনের জন্যি খাঁ খাঁ করিতো না। রতন ঘরামিরা আসলেই হারামির বাচ্চা হারামি। তাহারা ক্যানো যে বান্ধা জলে ঘর না বাঁন্ধিয়া মাইন্ষের কোলে ঘর বান্ধে- তাহা এই অধমের কিছুতেই বুঝে আসে না।
হৃদ বিদ্যা ও সুগার বিষয়ক
এমনিই হয়। তুমি বোঝ না। সুখেরা বোঝে। দু:খরা বোঝে।
সুখেরাও সুখ দ্যাখে চোরাবালি চক্ষু বুঁজে।
কষ্টের স্বভাব বোঝ? কষ্টেরও কথা হয় নীলকন্ঠি ময়ূরীর সাথে
তুমি? কষ্টের হাত ধরে বেহুদা সুগার বাড়াও অন্ধ রাতে।
হার্টের সার্জনেরাও আজকাল হৃদ বিদ্যা ভালো শিখেছেন
হৃৎপিন্ডকে প্লেটে রেখেও চৌকষ ভিজে নেয়াটা বুঝে নিয়েছেন।
অথচ তুমি ক্লাসিক কোমলতাকে সযতেœ আগলে রেখেও
টেরই পাও না সতৃষ্ণ গিরগিটিরা অদৃশ্যে জিভ ভাসিয়ে
কি ভাবে শুষে নেয় কামজলসহ পুরো তোমাকেই।
তার চেয়ে ভালো হয়, সুখ দু:খ দুটোকেই বুকের দু’পাশে রাখো
ফেলে দেয়া প্রিয় ভ্রুণকেও সুখদ কোন নাম ধরে ডাকো।
দেখবে- সুগার কমছে তো হার্টের ব্লকগুলো চেপে ধরছে
হার্টের ব্লকগুলো সরে যাচ্ছে তো বেজন্মা সুগার বেড়ে যাচ্ছে।
এমনিই হয়। তুমি বোঝ না। সুখেরা বোঝে। দু:খরা বোঝে।
হেমন্তের কড়চা
সময়ের অবসন্ন শরীর চুয়ে নেমে আসে
শ্রান্তির ঘামজ্বর।
আকাশের দুয়ার থাকে খোলা
আশ্বিনী বাতাসে লাগে শিশিরের দোলা।
শীতের অপেক্ষায় যে ছিল জড়সড় শুয়ে
সে পড়ে দ্বিধায়-
এ কি অঘ্রাণী ঘ্রাণ, নাকি ভাদ্রের ভদ্রতা কোনো?
যে প্রান্তিক কিষানির আঁচলে বাঁধা
দুঃখের সন্তানেরা খুঁটে খুঁটে খায়
ভাতগন্ধ বিকেলের সানন্দ মৌনতা-
নমিত ধানের গোছায় সে কোন হেমন্ত দেখে না।
হিমহিম কুয়াশার জালে জমে থাকে তার
ধানী উঠোনের ছায়া ছায়া রোদ
আর যাপিত জীবনের সুগন্ধ গৃহস্থালী।
নৈঃশব্দের ক্ষরণ থেকে
আমাকে যখন ঝলমলে রাজসভায় নিয়ে বলা হয়-
আপনি কবি, আপনি মানুষের চেয়েও বড়, এমন কি
ঈশ্বরের চেয়েও-
পারিষদবর্গ বিপুল হর্ষধ্বনিতে করতালি দেন।
সিংহাসন থেকে নেমে আসেন মহামান্য রাজা,
আমাকে কুর্নিশ করেন, নির্মাল্য পরিয়ে দেন গলায়।
আমি বিব্রত হই। বলি, এইসব সম্ভাষণ আমাকে
বিপন্ন করে রাজন। বড় বিষণœ করে।
আমি ঘর্মাক্ত কিষাণের রোদ মাথায় হাত রেখে বলি,
দ্যাখো তো হে মেপে, আমি কি তোমার চেয়েও বড়?
এক একটি সবুজাভ শিশুকে কোলে তুলে বলি-
দ্যাখো তো তোমার মাথা আমার উচ্চতাকে অতিক্রম
করেছে কিনা?
হে রাজন্যবর্গ, আমার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ
পাথুরে অভিঘাতে রাজাকে নিস্পন্দ করে।
কেন তবে বলি দেন আমাকে বিমূর্ত রাজার অভিজ্ঞানে?
কবিরা কখনো মানুষের সমোচ্চতায় গেলে কেউই কি
বলবে না- কবিরাই নৈঃশব্দের ক্ষরণ থেকে
বেরিয়ে এসে তারাই আমূল পাল্টে দিয়ে রচনা করেন
ফুলেল শয্যা সবার?
ভালোবাসাও পরেছে নূপুর
এইখানে বসেছে আজ চাঁদ ময়ুরীর মেলা
এসেছে অরণ্য নারী, এসেছে নৈঃশব্দের নদী
এসেছে সমুদ্র ধোয়া ডানায় কুহকী কোকিল
এসেছে শিশুদের ঠোঁটে পাখিদের কবোষ্ণ শীষ।
হে সূর্য সুন্দরতম, তুমিও নেমে এস শীতল উত্তাপে জড়িয়ে
প্রাচীন রোদ্র পালকে মিশে যাক্ জোছনার অবিনাশী টান
হে পর্ণকুটির, তুমিও ছায়া নিয়ে এস নিমপাতা, জারুলের
অহংকারী মুখোশে ঢেলে দাও নির্মল স্বচ্ছতা সুনীল।
এইখানে বন্যা নেমেছে আজ অজস্র নক্ষত্র আলোর
এইখানে ভালোবাসাও পরেছে নূপুর সান্ধ্য কালোর।
বন্ধকী জমিন
কোথাও তো থাকি না আসলে। নাগরিক ড্রেনে যে পাঁড় শূয়োরটাকে পড়ে থাকতে দ্যাখো - সে আমারই থ্যাঁতলানো শরীর বই কিছু নয়। জলতেষ্টায় কখনও যে জলধারা নারীর কাছে যাই - সে-ও তো সেই নীলাম্বরী আমসত্ত্বই। আর যারা ছাইভষ্ম লিখে লিখে উড়োচিঠি পাঠিয়েই যাচ্ছে বেওয়ারিশ মোকামে- তারা কি জানে না-সেই সবের একটি বিন্দুও আমার কোন পাঠোদ্ধারে লাগে না? লাশ গন্ধের নির্জনতায় যে একটু দেখে নেব ভেতরের ছেঁড়া-ফাটা ইচ্ছে ও নষ্টামি-তা-ও তো পারি না। ধেই ধেই তেড়ে আসে শহুরে বেতাল গবেষক। অথচ কে না জানে- গুহাবাসী মানুষেরাও বনসাঁই বৃক্ষ হয়ে ইঁদুরের লেজ ধরে হাপুস হুপুস বাঁচে। আর আমি যে নৈসর্গিক প্রান্তরের অন্বেষায় একটু ডুব দিয়েছি শিরিনের নাভীতলে - সেখানেও কি পাবো না হারানোর মতো এতটুকুন বন্ধকী জমিন?
ঘাসগৃহে প্রান্তিক বিহঙ্গ
কিছু ভুল মানুষের বসতি এখানে, জানে তা সবাই।
কেউ এসেছেন অপুষ্ট জরায়ুর পর্দা ছিঁড়ে
কেউ এসেছেন নক্ষত্রের নীলাভ ডানা ভেঙে
কেউ বা এসেছেন বুনো বাঁদরের গলা ধরে।
ওঁরা ধরেই নিয়েছেন- একটা চাঁদমুখো বারান্দা
নিশ্চিত ঝুলে আছে এই শহরেরই
কোন না কোন দালানের শাঁওলা দেয়াল ঘেঁষে।
কিন্তু ঘুম চোখ বসতিরা জানে না যে সমন এসেছে।
সমন এসেছে- জল নিদ্রা ভেঙ্গে ভেঙ্গে ফিরে যাক্ ওরা।
সমন এসেছে- যে যার গলিত জরায়ু মুখে
নমিত জননেন্দ্রিয়ের মতো থিতু হয়ে যাক।
সমন এসেছে - যে যার ঘন ঘাস গৃহে
নিঃসাড় নিঃসঙ্গ পড়ে থাক্ প্রান্তিক বিহঙ্গ হয়ে।
ফেরারী গন্ধ
ফেরা মানেই কি ফিরে আসা?
দ্বিধা হয়।
পদ্মা কন্যা শিরিনকে বলেছিলাম-
ফিরে এসো
সেই সব ফেরাগুলোকে সাথে নিয়ে
যে ফেরায় ছিল শুধু তোমারই গন্ধ।
অথচ সে এল, সত্যি সত্যিই এল
শরীরী এবং অশরীরী -দু’ভাবেই।
প্রত্মগন্ধী নেপথলিনের কৌলিন্য
আর না ফেরার ফেরারী গন্ধ-
দুই’ই ছিল তার শরীরে-অশরীরে।
No comments:
Post a Comment