আরতির প্রেম
আলমগীর হোসেন তারা
বৈশাখের বৈশাখী তুমি
কাল বৈশাখী ঝড়
শ্রাবণের কুল ভাঙ্গা নদী
ভাঙ্গে বাড়ি ঘড়।
জোষ্টের মধুমাস তুমি
ফুলে ফলে ভড়া
চৈত্রের খরো রোদ্র
প্রচণ্ড খরা।
“বাংলার রুপ” কবিতাটির প্রথম এ কয়েক লাইন সারাক্ষণ আওরাতে থাকে আরতি। কবিতাটি তার নিজের নয়, ওর এক প্রিয় তরুন লেখক অনিদ্রর। অনিদ্র ওর আসল নাম নয় ছন্দ নাম। যখনি পত্রিকার পাতায় অনিদ্রর কোন লেখা ছাপা হয়, আরতি সেটা সর্ব প্রথম এবং খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা পড়ে।
লেখক হিসেবে অনিদ্র নতুন, কিন্তু খুব ভালো লেখক। আরতির কেবলী মনে হয় ওর লেখার প্রতিটি শব্দের মধ্যে যাদুকরী আকর্ষন আছে। কিছু দিন আগে একটা গল্প ছাপা হয়েছিল “এমন কেন হয়”
গল্পটি পড়ে আরতি কেঁদে ফেলেছে। এর পূর্বে কোন দিন বই পড়ে মানুষ যে কাঁদে সে অভিজ্ঞতা ওর ছিল না।
আরতি অনিদ্রকে তার ভাললাগার কথা জানিয়ে একটা ধন্যবাদ দিতে চায়, কিন্তু কি ভাবে ? অনিদ্রের কোন ঠিকানা সে জানেনা, কোথায় থাকে, কি করে, কিছুই তার জানা নেই। গত কয়েক সংখ্যা হলো অনিদ্রের কোন লেখা পত্রিকায় আসছেনা, খুব খারাপ লাগে আরতির। ভাবে ওকি লেখা ছেড়েই দিলো, না তা তো হতে পারেনা, যার লেখা পড়ে মানুষ কাঁদতে পারে, সে ছোট লেখক নয়, আর তার কলম থেমে থাকবেনা এটা আরতির বিশ্বাস।
ক্যালেন্ডারের দিকে লক্ষ্য করে, আজ পনের তারিখ, এমাসের পত্রিকা তো আসার কথা, আজও এলো কেন ? হঠাৎ দরজায় করাঘাত, দরজা খুলতেই হকার তার হাতে তারই প্রিয় ম্যাগাজিনটা তুলে দিলো। আরতি পত্রিকাটি নিয়ে ভিতরে এসেই একের পর এক পাতা উল্টাতেই ওর নজরে পরলো একটা ভ্রমন কাহিনী, “মালেয়োশিয়ার টু ইন টাওয়ারের একদিন” লেখক “অনিদ্র” ।কাহিনীটিতে টাওয়ারের বেশ কয়েকটি ছবি ছাপা হয়েছে।
আরতির আরতি যেন মুহুর্তের মধ্যে স্রষ্টা পুর্ণ করে দিলো। খুসিতে ভড়ে উঠেলো তার মন প্রাণ। পত্রিকাটি হাতে নিয়ে ছুটে গেলো ওর বেড রুমে, দরজা লক করে বিছানায় শুয়ে মনোযোগ সহকারে ভ্রমন কাহিনীটি পড়তে লাগলো। কাহিনীটি পড়ে অনিদ্র সম্পর্কে অনেক কিছু জানলো আরতি। সেই সাথে কাহিনীটির শেষ অংশে ছোট করে অনিদ্রর ঠিকানাটও ছাপা হয়েছে। ঠিকানাটা পেয়ে আর ও আনন্দিত হলো আরতি।
সে সিদ্ধান্ত নিলো অনিদ্রকে সে লিখবে, কিন্তু কি ভাবে, কি সর্ম্বোধন করে, সেটা ঠিক করতে পারলনা। কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসলো-
প্রিয় অনিদ্র,
আমার ভালবাসা নিবেন। আমি আপনার ভক্ত একজন পাঠক।
এ পর্যন্ত লেখেই কলম থেমে গেলো, একি লিখছি আমি, ওর সঙ্গে তো পরিচয়ই হয়নি, তবে এভাবে লেখাকি ঠিক হলো, না, ছিঁড়ে ফেললো চিঠিটা। আবার লিখলো কয়েক লাইন, আবারও ছিঁড়ে ফেললো। কোন ভাবেই হচ্ছেনা। শেষে সাদাসিদা ভাবে সংক্ষিপ্ত করে লিখলো-
অনিদ্র সাহেব,
আপনার লেখা ভ্রমন কাহিনী “টু ইন টাওয়ারের একদিন” পড়লাম, খুব ভালো লিখেছেন। আমি কি ঐ টাওয়ারের রঙিন ছবি আশা করতে পারি ?
“আরতি”।
চিঠিটা মালেয়োশিয়ার ঠিকানায় পোষ্ট করল। কারন অনিদ্র মালেয়োশিয়াতে থাকে। আরতি আগে জানতো না যে অনিদ্র দেশের বাহিরে থাকে, ভ্রমন কাহিনীটি পড়েই সে জেনেছে। এরকম কাহিনী না লিখে শুধু গল্প আর কবিতা লিখলে হয়তো অনিদ্র সম্পর্কে আরতির সব কিছু অজানা থেকে যেতো।
চিঠি পেয়ে অনিদ্র বেশ আনন্দিত হলো, কারন এই প্রথম কোন মেয়ে তাকে এভাবে তার লেখার প্রসংসা করলো। এর পূর্বে ছেলেরা অবশ্য তাকে পত্রিকার মাধ্যমে এবং চিঠি লিখেও ধন্যবাদ দিয়েছে। অনিদ্র ভাবলো বেশ কিছু টাকা খরচ করে এবং বেশ পরিশ্রম করে মেয়েটা চিঠি দিয়েছে, তাই অন্য কারো চিঠির উওর না দিলেও এরটা দিতে হবে। অনিদ্র লিখলো-
আরতি,
আমার লেখার প্রসংসা করে কোন রমণির এই প্রথম চিঠি আমার জীবনে। উৎসাহিৎ করনের তরে তব প্রতি মোর ধন্যবাদ। কল্যানময় হোক তব ধরনী-
“অনিদ্র”।
দু’কপি টাওয়ারের ছবি সহ অনিদ্রর চিঠি খানা পেয়ে আরতি মহা খুসী। দেরি না করে আবারও লিখলো আরতি, তবে এবার একটু রঙ্গরস মিসিয়ে। চিঠিটা পেয়ে অনিদ্রর জীবনেও এলো নতুন এক জোয়ার। জীবনের প্রতি পরতে- পরতে বয়ে যেতে লাগলো হিমেল হাওয়া। ওর সব কাজে উৎসাহ বেড়ে গেলো দ্বিগুন। কবিতার সুন্দর- সুন্দর পক্তি এসে মনের মধ্যে ভিড় করতো। জীবনের সব কিছুই ওর কাছে মনে হতে লাগলো ছন্দময় কবিতা। অনিদ্রও লিখলো, মনের মাধুরী মিশিয়ে, ভালবাসার পক্তি দিয়ে সাজিয়ে। এভাবে চলতে লাগলো ওদের চিঠি আদান প্রদানের পালা।
চিঠি যতো আদান প্রদান হতে লাগলো, সম্পর্ক ততই গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগলো। আরতি এক চিঠিতে লিখলো- অনিদ্র তোমার একটি ছবি পাঠিয়ে দিও। উওরে অনিদ্র লিখলো- মনের আয়নায় আমাকে দেখো, দেখবে আমাকে খুঁজে পাবে, ছবির কোন দরকার হবে না, এটাও না হয় আমাদের জীবনে অবিস্বরণিয় ঘটনা হয়ে থাক।
আরতি লিখলো- তোমার ছবির কোন প্রয়োজন নেই, কারন আমার হৃদয়ের আয়নায় তোমাকে খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু আমার ছবি কি তুমি দেখবে না ? আমি কালো কি অসুন্দর, না দেখেই কি চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ?
“ যার চিঠির ভাষা এত সুন্দর, তার মন কোন কালে অসুন্দর হতে পারেনা। আর আমি ভালবাসি ঐ মনকেই, চিহারাকে নয়। আমার যদিও বিশ্বাস- তুমি অসুন্দর নও, তুমি যথেষ্ট সুন্দরী”।
আরতির উত্তরে কথাগুলো জানালো অনিদ্র। এভাবেই কেটে গেলো ছয়টি বৎসর। অনিদ্র এক চিঠিতে জানালো- আগামী ২৬ শে মে সকাল দশটায় আমি দেশে ফিরব, তুমি এয়ারপোটে উপস্থিত থাকবে। তুমি লাল শাড়ী পড়ে আসবে, আর চোখে কালো ফের্মের চশমা থাকবে। আমি পড়ে যাবো খয়রি রঙের টি-শাট, হাতে গোল্ডেন কালারের ঘড়ি, পায়ে কালো জুতা।
আরতি চিঠি পেয়ে খুসিতে আত্মহারা। কথাটা ওর বাবা- মাকেও জানালো, এবং আরও জানালো, আরতি সেই ছেলেকেই বিয়ে করবে। দিন ক্ষণ ঘনিয়ে আসতে লাগলো, ২৬শে মে সকাল ৮টায় এয়ারপোটে গিয়ে উপস্থিত হলো আরতি। একসময় বিমান ল্যান্ড করলো, পর্যায় ক্রমে যাত্রীরা বেড়িয়ে এলো। আরতির নেত্রযুগল খুঁজতে লাগলো ওর স্বপ্নের পুষটিকে। হঠাৎ যুগলদয় স্থির হয়ে গেলো- ঐতো খয়রী টি শাট, গোল্ডেন কালারের ঘড়ি, কালো জুতা, সব মিলে গেলো, কিন্তু মিলনা শুধু- অনিদ্র আরতির কাছে না এসে অন্য পাশ দিয়ে বেড় হলো। বেড় হতেই এক মেয়েও এক বয়স্ক লোক এগিয়ে গিয়ে অনিদ্রকে রিসিফ করলো, তার পর ওরা চলে গেলো মাইক্রো যোগে, এক সময় মাইক্রোটিও চোখের আরাল হলো। আরতির বুঝতে আর বাকী রইলনা, অনিদ্রর সঙ্গের মেয়েটি কে। আরতির নেত্রযুগলে শ্রাবণের বড়ষা এলো। ঝড়- ঝড় করে ঝড়তেও লাগলো সে গুলো। আরতির বাবা- মা ওকে ধরে নিয়ে গাড়ীতে উঠলো। এর কি কোন মানে হয়, এভাবে আরতিকে কেন ধোকা দিলো অনিদ্র।
বাড়ীতে গিয়ে বিছানায় উপর হয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো আরতি, সে জীবনে এত বড় ভুল করলো, কেন অযথা ভালবেসেছিল অনিদ্রকে। কি মিথ্যাবাদী, স্বার্থপর অনিদ্র, একটি বারের জন্যও সে জানায়নি সে বিবাহিত। কোন কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পরলো। সকালে কলিং বেলের বিরক্তি কর শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো আরতির। অনিচ্ছা সর্তেও গেট খোলার জন্য এগিয়ে গেলো, মনে মনে ভেবে রাখলো- যেই হোক গেট খুঁলেই করা ভাষায় একটা বকুনী দেবে, এতো সকালে কেউ কি এভাবে কলিংবেল টেপে।
গেট খুঁলেই থমকে গেলো, একি এতো অনিদ্র, তারই সামনে দাঁড়িয়ে।
- এখানে এসেছেন কেন ?
গভীর বিরক্তিতে কথাটা বললো আরতি। অনিদ্র বুঝলো গতকালের ঘটনায় আরতি রেগে আছে, বললো-
- রাগ করেছ ? দেখো আমার অনিচ্ছায় ঘটনাটা ঘটেছে, তোমাকে আমি ঠিকই দেখেছি, কিন্তু বাবা, বোন ওদের সামনে তোমার কাছে যেতে বড্ডো লজ্জা করচ্ছিল, প্লিজ ক্ষমা করে দাও।
খুসিতে ভড়ে গেলো আরতি, তবে ওটা বউ নয় বোন। আর ক্ষণকাল স্থির না থেকে লোক লজ্জার ভয় না করে জরিয়ে ধরলো অনিদ্রকে, অনিদ্রও জরিয়ে ধরলো আরতিকে। দু’জনার চোখ ভড়ে গেলো পানিতে, কয়েক ফোটা ঝড়ে পড়লো দু’জনার পিঠে, চমকে উঠলো দু’জনে-
- আরতি তুমি কাঁদছ ?
- তুমিওতো কাঁদছ।
- এ কাঁন্না নয় আরতি, এ হলো আনন্দের কাঁন্না, কাছে পাবার কাঁন্না।
“সমাপ্ত”
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক
No comments:
Post a Comment