নারীদের জন্য নিরাপদ হোক গণপরিবহন
মোহাম্মদ অংকন
উত্তরা
হতে মিরপুর যাওয়ার পথে সেদিন বাসে আমার পাশে একজন শিক্ষিকা বসেছিলেন। তিনি
আমার সর্ম্পকে জানতে চাইলে বলি, ‘আমি পড়াশোনা করি। পাশাপাশি কলাম লিখি।’
‘ও তুমি কলামিস্ট!’ একটি পত্রিকাতে লেখা দেখাতেই তিনি আমাকে গণপরিবহনে
নারীদের অনিরাপত্তাসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে লিখতে অনুরোধ করলেন। আমি তাঁর
আগ্রহ দেখে প্রশ্ন করলাম, ‘গণপরিবহনে আপনি কেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?’
তিনি উত্তর করলেন, ‘গণপরিবহনে যাতায়াত করাটা নারীদের জন্য যে আর নিরাপদ নয়,
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের ভয়ে ভয়ে গন্তব্যে পাড়ি জমাতে হয়। আর সব
তো আপনারা জানেনই।’
হ্যাঁ, আমরা সবাই সব কিছুই জানি। বর্তমানে দেশে
পরিবহনখাত একসম রাজ্যত্ব কায়েম করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের যখন যা খুশি তাই
করছে। বাস চাপা দিয়ে মানুষ হত্যা করছে, দূর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ হত্যা করছে।
এগুলো যেন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর গণপরিবহন নারীদের জন্য
এক আতঙ্কের নাম। নারীরা গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। চালক ও সহকারীর
হিংস্রতায় পরিবহনে নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পত্রপত্রিকায় প্রতিনিয়ত
এমন খবরা-খবর আসছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠনের পরিসংখ্যানেও বিষয়টি
স্পষ্ট। তারপরেও প্রতিকার না পেয়ে ও নানা অপ্রতুলতার কারণে নারীদের
প্রতিনিয়ত গণপরিবহন ব্যবহার করতে হচ্ছে। একাকী দূর পাল্লার পথ পাড়ি দিতে
হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা বেড়েছে।
তাঁদের প্রতিদিন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কর্মস্থলে যেতে হয়। এ ছাড়া
সংসারের নানা ধরনের প্রয়োজনে নারীদের ঘরের বাইরে বের হতে হয়। হাট-বাজার,
হাসপাতালে যেতে হয়। তাদের অনেকের যাতায়াতের জন্য গণপরিবহনই ভরসা। অথচ
গণপরিবহনে যাতায়াত করতে গিয়ে তারা প্রতিনিয়ত হেনস্থা ও যৌন হয়রানির শিকার
হচ্ছে। পুরুষ যাত্রীরা তো আছেই, পাশাপাশি চালক ও সহকারীরাও এ ধরনের অপকর্মে
অংশ নিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, কোনো তরুণী বাসে একা হলেই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এ
রকম চলতে থাকলে এ দেশের নারীরা গণপরিবহনে কীভাবে যাতায়াত করবে?
গণপরিবহনে
যেমন অনেকে নোংরা মানসিকতা নিয়ে পদচারনা করে, তেমনি পরিবহনের কর্মচারীরা
অশালীন কথাবার্তা ব্যবহার করে থাকে। নারীদের সাথে যৌন উস্কানীমুলক কথা
প্রয়োগ করে থাকে। শুধু কী তাই, পরিবহনে উঠতে গেলে প্রথমে ‘মহিলা সিট নাই,
মহিলা তুলিস না’ ইত্যাদি নানা ধরনের কথাবার্তা নারীদের শুনতে হয়। এ সবের
প্রতিবাদ করলে পরিবহনের অধিকাংশ যাত্রীরা নারীদেরকেই দোষ দেয়। এটা নারীদের
নিত্যদিনের বাস্তবতা। প্রতিদিন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও অফিসের সময় যে
কোনো যানবাহনে উঠতে সবাইকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। যদিও এ যুদ্ধ নারী-পুরুষ
উভয়ের জন্যই, তবে আমরা পুরুষরা কোনো না কোনো ভাবে রেহাই পেয়ে যাই। আর
নারীরা সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হয়। তাদের যে কোনো উপায় নাই। তারা
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অসহায়।
আমি সপ্তাহে পাঁচ দিন গণপরিবহনে
যাতায়াত করে থাকি। এ সময় অনেক কিছুই চোখ দিয়ে দেখে থাকি। যেমনটা- অনেক
পুরুষ পরিবহনে নারীদের শরীরে ইচ্ছে করেই স্পর্শ করে। অনেক পুরুষ ইচ্ছে করেই
নারী যাত্রীদের শরীরের ওপর ঢলে পড়ে। অনেক সময় অপ্রয়োজনে নারীদের শরীরে হাত
দেয়। এসব নিয়ে নারীদেরকে কম-বেশি প্রতিবাদ করতে দেখি। আমরাও সচেতনরা
প্রতিবাদ করি। কিন্তু ঐসব অসভ্যদের মুখ থেকে গালিগালাজ শুনতে হয়। ‘এতো
অসুবিধা হলে পরিবহন থেকে নেমে যা!’ অনেকে অজুহাত দেখিয়ে বলে, ‘ইচ্ছে করে
ধাক্কা দেইনি।’ আর পরিবহনের সহকারীরা নারী যাত্রী উঠানোর সময় তাদের শরীরে
হাত দিবেই এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার ভাড়া আদায়ের সময় নারীদের শরীর
স্পর্শ করে দাঁড়ায়, হাতে হাত দেয় ইত্যাদি। আমি মনে করি, এ সব কিছুর মুলে
রয়েছে দেশের বর্তমান পরিবহনখাতের নৈরাজ্য ও দৌরাত্ন্যতা।
দেখুন,
আমাদের দেশে গণপরিবহনে চালক ও সহকারী নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-কানুন
মান্য করা হয় না। মালিকপক্ষ তাদের ইচ্ছামতো পরিবহন শ্রমিক নিয়োগ করে থাকে।
গাড়িতে চালক ও সহকারী নিয়োগের বিষয়টি শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে না পারলে তারা
যেমন দূর্ঘটনা ঘটাবে, তেমনি নারীদেরকে যৌন হয়রানি করবে। তাদের নিয়োগপত্র
দিয়েই নিয়োগ দিতে হবে। আর এতে বিভিন্ন শর্তের কথা উল্লেখ থাকতে হবে। তাদের
পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে এবং অতীতের কর্মকান্ড যাচাই করে ছবি ও দরকারি
সব তথ্য নিয়ে তবেই কাজে নিয়োগ দিতে হবে। যাতে কোনো অপরাধ করলে তাদের দ্রুত
শনাক্ত করা যায়। এ ছাড়া মালিকদের উচিত, যাত্রীদের সঙ্গে চালক ও সহকারীর
আচরণ কেমন হবে, সে ব্যাপারে পরিবহন কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। এ বিষষটি
লাইসেন্স প্রাপ্তির সময়ও যাচাই করা দরকার।
আমরা জেনেছি, গণপরিবহনে
নারীদের আসন প্রাপ্তি নিশ্চতকরণে ও ভোগান্তি কমাতে পরিবহনে সংরক্ষিত আসন
রাখার জন্য সকল পরিবহনকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখেছি,
অধিকাংশ পরিবহনেই নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নাই। আর দু’্একটি পরিবহনে আসন
থাকলেও তা থাকে পুরুষদের দখলে। যদিও নারীদের সংরক্ষিত আসনে পুুরুষ যাত্রী
বসলে জেল-জরিমানার বিধান রেখে আইন পাস করেছে সরকার। কিন্তু কোনো পুরুষই এ
আইন মানছে না। তাই বলি, শুধু আইন করলে হবে না এর বাস্তবায়নে জনসচেতনতা তৈরি
করতে হবে। গাড়িতে গাড়িতে আইনের বিধানগুলো উল্লেখ করতে হবে যাতে সবাই জানতে
পারে। এবং চালকদেরকে এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ হতে হবে যেন নারীদের আসনে পুরুষ
যাত্রী না বসায়। সর্বোপরি, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করতে হবে।
বিবেককে প্রশ্ন করতে হবে, পরিবহনে কেন আমি নারীর আসনে বসব?
গণপরিবহনে
নারীদের প্রধান যে সমস্যা তাহল- যৌন হয়রানি। তাই গণপরিবহনে নারীদের
নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বা সংরক্ষিত আসনের
বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পরিবহন স্টপেজগুলোয় ভ্রাম্যমাণ আদালতের ব্যবস্থা করতে
হবে। আমরা দেখে থাকি, কোনো কোনো গাড়িতে যাত্রীদের অভিযোগ দেওয়ার জন্য
মালিকের মোবাইল নাম্বার দেওয়া থাকে। নারীরা যৌন হয়রানি নিয়ে যখন অভিযোগ
করে, মালিক পক্ষ তখন তা এড়িয়ে যায়। কিংবা সমাধানের আশ্বাস দিয়েও সমাধান দেয়
না। এ ধরনের স্বেচ্ছাচারীতা দূরীকরণে প্রতিটি গাড়িতে মালিকের নাম্বারের
পাশাপাশি পুলিশ-প্রশাসনের মোবাইল নাম্বার দিতে হবে। এর ফলে যে কোনো জায়গা
থেকেই নারীরা এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়লে পুলিশকে জানাতে পারবে এবং দায়িত্বরত
ট্রাফিক সার্জেন্টরা সেই গাড়ি চিহ্নিত করতে পারবে।
দেশের
অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নারীদের পদচারণা বেড়েছে
কয়েকগুণ। রাজধানী ঢাকাতেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কর্মক্ষেত্রে
যেতে প্রতিদিন রাস্তায় নামছেন কয়েক লাখ নারী। আর ঠিক সে সময় নারীরা পড়ছে
অনিরাপত্তার মুখে। হচ্ছে যৌন নির্যাতিত। যখন নারীরা দেশের উন্নয়নে পা
বাড়াচ্ছেন, তখন কি তাদেরকে নিরাপত্তা দেওয়া উচিৎ নয়? তাদের যাতায়াতের
সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো কি প্রয়োজন নয়?। বরং সামাজিক নানা সমস্যা সৃষ্টি করার
মধ্য দিয়ে তাদেরকে প্রতিহত করা হচ্ছে। তাই বর্তমান সরকারকে গণপরিবহনে নারীর
নিরাপত্তার লক্ষ্যে কাজ করতে আহ্বান করছি। সরকারের গৃহিত পদক্ষেপই পারে
গণপরিবহনে যৌন হয়রানি প্রতিরোধসহ যাবতীয় সমস্যার সমাধান করতে। আশা করছি,
আমার দেশের নারীরা একদিন না একদিন গণপরিবহনে নিরাপত্তা পাবে।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট, ঢাকা।
No comments:
Post a Comment