শিশুকিশোর গল্প-৪
আদন ও তুলির ঝগড়া
কবির কাঞ্চন
এবার বর্ষা 
শুরু হবার বেশ আগে থেকেই মুষলধারে অঝরে বৃষ্টি নেমেছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের
 নদী-নালা-মাঠ-ঘাট সব ভরে একাকার হয়ে স্থলভাগেও জলস্রোত আনাগোনা শুরু করে 
দিয়েছে। এদেশে প্রতি বছরই কোন না কোন অঞ্চলের সাথে বন্যার সাক্ষাত ঘটছে। 
যেন চিরচেনা কোন বন্ধুত্ব। এক বন্ধুকে ছেড়ে আরেক বন্ধুর এক বছরের বেশি সময় 
দূরে না থাকা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে গ্রীষ্মের এই গরমক্ষণেও 
হঠাৎ মেঘের সরব উপস্থিতি সবাইকে যেন মৃদু হাওয়ার শীতল ছোঁয়ায় কিছুটা হলেও 
স্বস্তি এনে দিয়েছে। বাতাস বাড়ার সাথে সাথে ঘনকালো মেঘের গুঞ্জণে আকাশের 
কান্না হয়ে পৃথিবীর বুকে নেমে আসছে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির পানির এতোই 
উচ্ছ্বাস যে শহরের সরু নালা-নর্দমা ভরে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিতে থাকে 
অলি-গলিতে। ইতোমধ্যে পানি স্থান করে নিয়েছে কিছু কিছু নিচু রাস্তার বুক 
জুড়ে। রাস্তার ধারের নিচু বাসাগুলোর উঠোনেও পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
শহরের
 এককোণে তুলি আর আদনদের বাসা। বয়সে ওরা তিন থেকে সাড়ে তিন বছরের শিশু। 
তুলিদের বাসার ঠিক সামনেই রয়েছে আদনদের বাসা। দুই বাসার ঠিক মাঝেই রয়েছে 
ছোট্ট একটি খেলার মাঠের মতো ফাঁকা জায়গা। এই মাঠেই দিনের কিছুসময় ওরা মনের 
আনন্দে হাসে-নাচে। শহরে যেখানে ছেলে-মেয়েরা তাদের বাবা-মায়ের সাথে ঠিকমতো 
ঘুমানোর জায়গা-ই পায় না, সেখানে হোক না তা ছোট কিন্তু বাসার সামনে এই 
সামান্য জায়গাটার মূল্যই বা কম কিসে! এমন প্রবল বৃষ্টির জলের উন্মাদনায় 
ধীরে ধীরে সেই উঠোনের জল প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। পাশেই টিনের ঘর। টিনের 
চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দে আদনের ঘুম ভাঙ্গে।
বৃষ্টির শব্দকে শিশুরা 
খুব ভালবাসে। জলের কোমল ছোঁয়া গায়ে মেখে মজা নিতে পারার মাঝে ওরা সুখ 
খোঁজে। আদন ঘুমঘুম চোখে খালি গায়ে ঘর থেকে বের হতে থাকে। দূর থেকে ওর বাবার
 চোখ পড়ে ছেলের ওপর। তিনি আদনকে ঘর থেকে বেরুতে বারণ করেন। আদন সেদিকে 
খেয়াল না করে চলে যাচ্ছে।
এরপর তিনি স্ত্রীকে ডেকে বলে উঠেন, 
- এই 
তীব্রতা, দেখো, দেখো আমাদের আদন খালি গায়ে ঘরের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাইরে 
খুব বৃষ্টি হচ্ছে। ওকে থামাও। তোমার ছেলে আমার কথা শুনছে না।
আদনের মা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, 
- এই হলো বাবা আর মায়ের মধ্যে আসল তফাৎ। বলি, ছেলে কি শুধু আমার? তোমার না!
আদনের বাবা বিষন্ন চোখে তাকিয়ে বললেন, 
-
 আমি কিন্তু সেভাবে বলিনি। ছেলে-মেয়েরা সারাক্ষণ মায়ের সাথে সাথে থাকে। 
আমরা বাবারা সারাক্ষণ সংসারের আর্থিক যোগানের কথা মাথায় নিয়ে বাইরে-ঘরে পড়ে
 থাকি। তার মানে এই নয় যে, সন্তানের প্রতি আমাদের ভালবাসা মায়েদের চেয়ে কোন
 অংশে কম।
আদনের মা স্বামীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, 
- আরে! তুমি দেখছি মন খারাপ করেছো। এমনিতেই কথাটা বললাম। আমি তোমাকে খোঁচা মেরে কথা বলতে চাইনি।
এই
 কথা বলতে বলতে ছেলেকে দৌড়ে ধরে আবার নিজেদের রুমে নিয়ে আসেন। কিন্তু 
কোনভাবেই আদনের মন থেকে বাইরে যাবার কথা ভুলিয়ে দিতে পারছেন না। শেষে আদনের
 বাবার অনুরোধে বাইরে যেতে দিলেন। 
আর মাত্র ক’দিন পরেই ঈদুল আজহা। ওর জন্য কিনে আনা নতুন জামা-কাপড় পরিয়ে দিয়েছেন মা। নতুন জামা-কাপড় পরতে পেরে আদনের সে কী আনন্দ! 
আদনকে এমন আনন্দে মাততে দেখে পাশ থেকে ওর মা বললেন, 
-
 শোন বাবা, এইটা তোমার ঈদের জামা। এই জামা পরে বাইরে বেশি সময় ধরে থেকো না।
 তাড়াতাড়ি ঘরে চলে এসো। আর সাবধান, একদম পানিতে নেমো না! ঈদের জামা অন্যরা 
আগে দেখে গেলে ঈদের দিনে নতুন জামা পরার মজা কিন্তু মাটি হয়ে যাবে।
আদন
 মায়ের এমন কথার মানে খুঁজে না। শুধু ঘাঁড় নেড়ে ঘরের বাইরে ছোটে। বাইরে পা 
রাখতেই ও দেখতে পায়-পাশের বাসার তুলি পানিতে নেমে জল ছিটাছিটি করছে। 
বৃষ্টির জল গায়ে মেখে পরম আনন্দে তুলি কর্দমাক্ত পানিতে লাফালাফি করছে। ওকে
 এভাবে আনন্দে লাফাতে দেখে সব কিছু ভুলে আদনও পানিতে নেমে পড়ে। আদন তুলির 
খেলার সাথী। আদনকে নিজের দিকে আসতে দেখে তুলির আনন্দের মাত্রা যেন 
মুহূর্তেই দ্বিগুণ হয়ে গেলো। সে দৌড়ে এসে আদনের হাত ধরে মাঠের মাঝ বরাবর 
দাঁড়ায়। তারপর দু’জনে আনন্দে লাফাতে থাকে। মাঠের পানির উচ্চতা ধীরে ধীরে 
বেড়েই চলেছে। তুলি আর আদনের মধ্যে তুলি বয়সে আদনের চেয়ে কয়েক মাসের বড় হবে।
সে আদনকে বলল, 
- এই সাবধানে হাঁটো নাইলে কিন্তু পানিতে পড়ে যাবে।
তার
 কথা শেষ হতে না হতেই আদন তুলির হাতটা ছেড়ে দিয়ে এদিক-সেদিক লাফাতে থাকে। 
তুলি আদনকে এভাবে লাফাতে দেখে আদনের দিকে দৌড় দেয়। হঠাৎ আদনের গায়ের সাথে 
মুখোমুখি ধাক্কা লাগে তার। মুহূর্তে আদন পানিতে পড়ে যায়। তার জামা-কাপড় তো 
কাদায় ভরেছেই। তার উপর গায়েও বেশ ব্যথা পেয়েছে। ব্যথায় সে চিৎকার করে 
কাঁন্না শুরু করে দিয়েছে। তার কান্নার আওয়াজ শুনে ঘরের ভিতর থেকে দৌড়ে ছুটে
 আসেন তার মা। আদনের বাবা তখনও ঘরে বসে অফিসের গুরুত্বপূর্ণ হিসাব-নিকাশ 
নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।  আদনের মা ছেলেকে ময়লা পানিতে বসে বসে কাঁদতে দেখে 
দ্রুত গিয়ে বাসার দিকে নিয়ে আসতে আসতে বললেন, 
- বাবা, এতো সুন্দর জামা-কাপড় ময়লা পানিতে নেমে কেন শুধু শুধু নষ্ট করলি?
আদন অভিযোগের সুরে বলল, 
- মা, আমি নষ্ট করিনি। তুলি আমাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছে।
ছেলের
 মুখ থেকে কথাটা শোনার সাথে সাথে আদনের মা ওকে ছেড়ে দিয়ে পাশের ছাদের নিচে 
দাঁড়িয়ে থাকা তুলিকে ধরে এনে গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। থাপ্পড়ে ব্যথা 
পেয়ে তুলিও খুব জোরেশোরে কাঁদতে শুরু করলো। তার কান্নার আওয়াজ শুনে তুলির 
মাও ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। 
এসেই কৈফিয়তের গলায় জিজ্ঞেস করলেন, 
- কিরে আবার কাঁদছিস কেন? তোকে কে মেরেছে?
তুলি কাঁদতে কাঁদতে বলল, 
- মা, আমাকে আদনের আম্মু শুধু শুধু মেরেছে। আমি কিছুই করিনি।
এরপর তুলির মা আদনের মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, 
- কি গো আদনের মা, আমার তুলিকে শুধু শুধু মেরেছো কেন? এই বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। 
আদনের মাও ছেড়ে কথা বলার পাত্রী নন। তিনি আরো উত্তেজিত হয়ে বললেন, 
- মেরেছি তো বেশ করেছি। এমন দুষ্ট মেয়েকে ঘরে ধরে রাখতে পারো না। আমার ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে ও।
তুলির
 মাও পাল্টা জবাব দিতে থাকে। দেখতে দেখতে তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেলো। তাদের 
চেঁচামেচিতে বাড়ির নারী-পুরুষসহ শিশু-কিশোররাও বের হয়ে এসে ছাদের নিচে 
জমায়েত হলো। তারা প্রাণপনে চিৎকার করে ঝগড়া করেই চললেন। কেউ-ই কারোর কথা 
শুনছেন না। তাদের ঝগড়ার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মুখের 
ঝগড়া হাতাহাতিতে এবং শেষে মারামারিতে পৌঁছে যাবে। এসময় ঘরের ভিতর থেকে সকল 
হিসাব-নিকাশ ফেলে রেখে বের হয়ে আসেন আদনের বাবা। এসেই তিনি বললেন, 
- তোমরা এই সব কি করছো! বাচ্চারা এ রকম একটু ঝুট-ঝামেলা করতেই পারে। তাই বলে কী আমরাও ওদের মতো অবুঝ হবো? ঝগড়া করবো?
আদনের
 বাবা যতোই সদোপদেশ দিক না কেন? কে শুনে তার উপদেশ। সবাই ঝগড়া নিয়ে ব্যস্ত।
 এরিমধ্যে ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আদন তার সামনে দিয়ে পানিরস্রোতে ভেসে 
যাওয়া একটি বাঁশি দেখে দৌড়ে নেমে পড়ে পানিতে। সে বাঁশিটির পিছুপিছু ছোটে। 
ওকে এভাবে আনন্দে বাঁশির পিছে ছুটতে দেখে তুলিও দৌড়ে আসে। তারপর দু’জনে 
বাঁশির পিছুপিছু গেইট পর্যন্ত চলে যায়। বাসার মূল গেইটে দেয়ালের সাথে 
বাঁশিটি আটকে যায়। আদন পানির মধ্য থেকে বাঁশিটি তুলে নিলে তুলি আনন্দে 
লাফাতে থাকে। 
“সুন্দর বাঁশি পেয়েছি!” “সুন্দর বাঁশি পেয়েছি!” এই বলে 
ওরা আনন্দে চিৎকার করতে লাগলো। ওদের এমন উল্লাস দেখে সেদিকে উপস্থিত সবার 
দৃষ্টি পড়ে। 
তারপর আদনের বাবা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 
- যাদের 
নিয়ে তোমরা এতক্ষণ ধরে ঝগড়া করলে, চেয়ে দেখো, সেই তারা-ই আবার কতো মজা করে 
আনন্দে লাফালাফি করছে! কিছুক্ষণ আগে এরা একে অন্যের সাথে ঝগড়া করেছে। 
একজনের প্রতি আরেকজনের বেশ রাগ জমেছিল। কিন্তু কিছু সময়ের ব্যবধানে ওরা মন 
থেকে সব ভুলে গিয়ে আবার আগের মতো আপন হয়ে গেছে। ওদের আনন্দ দেখে মনে হচ্ছে 
ওরা মোটেও ঝগড়া করেনি। মিছে অভিমান শুধু করেছিল; আরো কাছে পাওয়ার জন্য।
আদনের
 বাবার এমন বক্তব্যে আদন ও তুলির মা লজ্জিত হলো। উপস্থিত সকলে নিশ্চুপ হয়ে 
ওদের কচিমনের নিষ্পাপ উল্লাস করা দৃশ্যকে উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
 
 
 
 
 
 
 
 
![গুরুত্বপূর্ণ লিংক সমূহ:- [Software]](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgd7Uhk0-zI7vLfnGe-FcxKizqCZhwcVa3RIvE-sqtRVJO9LHwDe8nREY9vUfEcbzGu6-FiohrFp0tdm2Ta3t59p74gB46tZJjd2Wm4H3eqSrqKvw8E2eoxPWuQ-xI506nMaqyL4w5gDU8/w72-h72-p-k-no-nu/2.jpg) 
 
 
 
 

 
 
No comments:
Post a Comment