রাজকপাল
আশরাফ চঞ্চল
আমার মা বাবার সংসারে প্রথম সন্তান মেয়ে।গ্রামীণ এলাকায় কোনো পরিবারে মেয়ে সন্তানের জন্ম হলে সকলেই নাক ছিটকায়, ঠাট্টা মশকরার অন্ত থাকে না। খুশি হয় না কেউ-ই। আমার মা বাবার বেলায়ও তাই ঘটেছিল। আমার বড় আপা যেন সংসারের বিপত্তি। অশুভ - অকল্যাণ-অশান্তি!
বড় আপার জন্মের ঠিক দুই বছর পর, এমন এক অশান্তির সংসারে আমি আসি এক্কেবারে রাজপুত্রের মত হয়ে। আমি যে শিশ্নঅলা! আমাকে দেখে সংসারে খুশির জোয়ার বয়ে যায়। আনন্দ -উৎসবের শেষ থাকেনা। তাদের কাছে একরত্তি এই আমি যেন দেবশিশু, অকথিত ভগবান, ভাগ্যের দেবতা! নইলে কী আর আতুর ঘরেই আব্বা এসে চুমুর পর চুমু খায়?! তাদের হাবভাব দেখে মনে হয় আমার যেনো রাজকপাল!
কেবল একজন মায়ের কাছেই ছেলে মেয়েতে তফাৎ নেই। সন্তান তো সন্তানই। ছেলে মেয়ে উভয়ই তার কাছে সমানে সমান! আমি যেমন তাঁর কাছে রাজপুত্তুর তেমনি বড় আপাও তাঁর কাছে রাজপুত্রী! তবুও সবার সাথে তাল মিলিয়ে মা যেনো আমাকে একটু বেশিই যত্ন আত্তি করেন। কুলে নিয়ে বলতে থাকেন, 'আরমার্ড পোলা রাজকপাইল্যা, একদিন সে রাজা বাদশাহর মতো অনেক বড় হবে '
এভাবে দিন যায়।মাস যায়। বছর যায়। আমি একটু একটু করে বড় হই। হাঁটতে শিখি। ভেঙে ভেঙে আব্বু বলি, আম্মু বলি। যে কারো মুখের দিকে তাকিয়েই মুচকি হেসে আদর কুড়াই। আমার বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে দিন দিন অভাব কেবল বেড়েই চলে। বাড়তেই থাকে।
নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে তিনবেলার কবেলাও একমুঠো ভাত জুটেনা। দেখতে
দেখতেই মায়ের বুকের দুধ শুকিয়ে আসে। আমার পেটেও ক্ষুধা বাড়ে। সারাক্ষণ ক্ষুধার্ত পেটে কাতরাই। মায়ের এই শুকনো বুক যেনো আমার কাছে মরুভূমি সাহারা!
এভাবে দিন যায় দিন আসে। রাতের পর রাত আসে। সংসারে একটার পর একটা অঘটন লাগতেই থাকে। আমার জন্মের পর থেকেই নাকি এসব শুরু হইছে! রাজকপাল নয় একটা পোড়াকপাল নিয়ে যেনো এসেছি। আমাকে নিয়ে দন্ধ কলহের সীমা পরিসীমা নেই। সব আদর আহ্লাদ কমতে থাকে।কেবল মা ছাড়া সবার কাছেই আমি একটা উৎপাত! কুলক্ষণে - অজাত- অপছায়া!
আমার কারনেই মা একদিন সংসারছাড়া হয় ঘরছাড়া হয় স্বামীছাড়া হয়। যৌথ পারিবারিক সিদ্ধান্তে মাকে তালাক দিয়ে দেন আমার বাবা। যে কোন মেয়ে মানুষের শেষ ভরসা বাপের বাড়ি। মা দিকদিশা না পেয়ে বাপের বাড়িতেই ছোটেন। কথায় বলেনা, অভাগা যেদিকে যায় সাগরও শুকিয়ে যায়! আমার নানার বাড়ির লোকজনও মাকে আশ্রয় দিতে চায়না। কারন একটাই, সেটা আমি। আমি যে অন্য ফ্যামিলির জঞ্জাল। এই উৎপাত তারা রাখবে কেন? তাই মা একদিন চোখ ভরা জল নিয়ে পথে নামেন। সেই থেকে আমি পথের মানুষ। পথেই আমার ঠিকানা।
আমি এখন জলজ্যান্ত যুবক। ভার্সিটিতে পড়ি। আমার বাপের কথা জিগ্যেস করলে মা কাদতে কাদতে উপরোক্ত গল্পটি বলেন। আমার রাজকপাল না পোড়াকপাল তা একমাত্র বিধাতাই জানে।
No comments:
Post a Comment