হোম কোয়ারেন্টাইন
আশরাফ চঞ্চল
নাজমার বাপ হোম কোয়ারেন্টাইন কী বুঝেনা। বুঝার কথাও না। বেচারা আদতেই একজন অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষ। শিশুকাল থেকেই অভাব তার নিত্যসঙ্গী। নুন আনতে পান্তা ফুরায় যে সংসারে, সেখানে লেখাপড়ার মূল্য নেই। নাজমার বাপ তাই স্কুলে যায়নি। উপোসের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হবার পর থেকেই কাজে লেগে গেছে। তবুও অভাব আজও তার পিছু ছাড়েনি। দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কী! নাজমার বাপের জীবনটাও সে রকম। এ নিয়ে তার দুঃখবোধ নেই। বহুদিন ধরে সে রিকশা চালায়। সে জানে হেডেল ঘুরলেই টাকা, চাল ডাল লবণ তেল। হেডেল না ঘুরলেই উপোস। ক্ষুধার্ত ছেলে মেয়েদের বিরামহীন কান্না!
ইদানীং দেশে নাকি কী ছাতার করোনা আইছে! পুলিশ রিকশা নিয়ে রাস্তায় উঠতেই দেয়না। রাস্তায় উঠলেই বেতের লাঠি নিয়ে সন্ত্রাসীর মত দৌড়ে আসে। ইচ্ছেমত পিটায়। বিশ্রী ভাষায় গালি দেয়, 'এই .... জানস না দেশে যে করোনার মহামারি লাগছে! ঘরে চাল না থাকলে হাওয়া খেয়ে থাকবি। যতদিন লকডাউন থাকবে ততদিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবি, রাস্তায় উঠলে... দিয়া রোল ঢুকামু শালা ... পোলা।'
নাজমার বাপের কাছে করোনার চেয়ে পুলিশের ভয় বেশি। বিরামহীন পরিশ্রমে শরীরে এমনিতেই শক্তির বালাই নেই, পুলিশের এক ঘা খেলেই একেবারে জান বের হয়ে যাবে! এছাড়া বেশ কয়েকদিন ধরে শরীরে জ্বর জ্বর ভাব। মাথাটা সারাক্ষণ ঝিম মেরে থাকে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার মত টাকা হাতে নেই। পেটে যার ভাত নেই তার আবার চিকিৎসা! অসুস্থ শরীর আর পুলিশের ভয় এই দোলাচালে গত তিনদিন ধরে ঘরবন্দী হয়ে থাকার পর, ঘরের সব সম্বল শেষ হয়ে আসে। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য হয়না, ছেলে মেয়েদের কান্না আর বউয়ের খোঁচা মার্কা কথায় জীবনটা তার কাছে নরকপুরির মত লাগে! আল্লাহ অন্ধ নাকি?! নিশ্চয় অন্ধের চেয়ে আরও বেশি অন্ধ! নইলে একবারের জন্যে হলেও চোখ মেলে তাকাতেন। তিনি কিছু দেখতে পান না বলেই পরিবারে সমাজে রাষ্ট্রে এতসব অনিয়ম আর অরাজকতা! সে যখন যুবক একদল লোক আসতো খারুয়া বাজারে সমাজতন্ত্রের বার্তা নিয়ে। তারা মাসে মাসে মিটিং করতো। তারা রাশিয়ার লেলিনবাদ নীতির প্রচার করতো। লেলিন এমন এক ব্যক্তি যে কিনা গোটা পৃথিবীটাকে একটামাত্র সমাজে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তার নীতি অনুসারে পৃথিবীর সব মানুষ হবে একই পরিবারভুক্ত। সকলের হবে সমান অধিকার। খাবার থাকলে সবাই খাবে,আর না থাকলে কেউ খাবেনা। কেউ থাকবে সাত তলায় আর কেউ গাছ তলায় তা হতে পারেনা। সেই থেকে লেলিন যেন তার কাছে দেবতাতুল্য! চোখঅলা ঈশ্বর! এই নীতির বাস্তবায়ন হলে আজ অসুখ শরীরে রুজির সন্ধানে বের হওয়া লাগতোনা। দুনিয়ার সব হালারাই বোকা। আসলে মানুষ জাতটাই খুব হারামি! নইলে কী আর লেলিনের নীতি এভাবে রসাতলে যায়? এসব ভাবতে ভাবতে চোখে মুখে ঘোরলাগা ভাব নিয়ে সে রাস্তায় উড়ে আসে। পুলিশ যে মাছ শিকারীর ন্যায় টোপ ফেলে বসে আছে সেদিকে তার খেয়াল নেই! পিঠে রোলের আঘাত পড়তেই যেন সম্বিত ফিরে আসে। ঘরে যে চাল নেই এই কথাটুকু বলার মত সুযোগও পায়না সে। তার আগেই একটার পর একটা লাঠির আঘাতে জ্ঞানশূণ্য হয়ে রিকশা থেকে পাকা রাস্তার উপর লুটিয়ে পড়ে! তবুও লাঠি চলতেই থাকে। পুলিশের কাছে নাজমার বাপ যেন মানুষ না, ফণাঅলা বিষাক্ত সাপ!!!
আশরাফ চঞ্চল
টাওয়াইল
খারুয়া,নান্দাইল,ময়মনসিংহ।
No comments:
Post a Comment