বৃষ্টি মেয়ের মিষ্টি গান
মির্জা নূরুন্নবী
সময় এখন বর্ষার। দিনরাত বৃষ্টি আর বৃষ্টি! টিনের চালে পড়া
বৃষ্টির ছড়া যেন মনকাড়ে সবারই। আমার নিজেরও। আপনারও নিশ্চয়ই। বৃষ্টি নিয়ে
যারা সৃষ্টি করেন ছড়া, কবিতা, গল্প কিংবা প্রবন্ধ তাদের বিষয়তো আরো
অন্যরকম। তাদের অনুভূতি ভিন্নজগতের। ভিন্নদৃষ্টির। একেকজন কবি একেক রকমে
তুলে এনেছেন বৃষ্টিকে। কেউবা মানবিক দৃষ্টিকোণে! কেউবা প্রেমের আদলে। কারো
দৃষ্টি আবার ছোটদের জন্য। আদরের জন্য। কেউবা ফুলপাখিদের সাথে। বকুল ফুলের
মালা গেঁথেছেন কেউবা। আমরা বৃষ্টি নিয়ে অনেক ছড়া কবিতাই পড়েছি। পড়েছি
আষাঢ়ের ছড়া। নদী ভাঙ্গার ছড়া। কাশবনের ছড়া। বাঁশবনের ছড়া। কবিদের এরকম
হাজারো ছড়া কবিতা থেকে কয়েকটি ছড়া কবিতা নিয়ে আজকের এই আয়োজন। বৃষ্টি নিয়ে
সৃষ্টি করা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আষাঢ় কবিতাটি আজো ভুলতে পারিনি।
সেই প্রাইমারি জীবনে পড়েছিলাম-
নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে
তিল ঠাঁই আর নাহিরে
ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর
আউশের খেত জলে ভরভর
কালি-মাখা ওপারে আঁধার
ঘনিয়েছে দেখ চাহিরে।
ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।
সত্যিই আমরা যখন আষাঢ় শ্রাবণের আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখি তখন
আতকে ওঠে আমাদের হৃদয়। আতকে ওঠে মনোপ্রাণ। ভয়ে জড়োসড়ো হই আমরা অনেকেই।
আমাদের ছেলেমেয়েদের বাইরে যেতে বারণ করি। আদরে কাছে জড়িয়ে রাখতে চেষ্টা
করি। ঠান্ডায় যাতে কষ্ট না পায় তারজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি।
এরপরও বৃষ্টির সাথে আমাদের সখ্যতার কমতি নেই। বৃষ্টির সাথে গেঁথে রয়েছে
আমাদের জীবনের অনেক কিছুই। রয়েছে প্রেমের পরশ। রয়েছে আবেগ অনুভূতি।
পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের ভাষায়-
বাহিরে নাচিছে ঝরঝর জল গুরুগুরু মেঘ ডাকে,
এসবের মাঝে রূপকথা যেন আর রূপকথা আঁকে।
আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জলধারে,
বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে!
আসলেই বৃষ্টির দিনে ঘরে বসে প্রেমিকাকে নিয়ে ভাবতে বেশ মজাই
লাগে। মনের মাধুরী মিশিয়ে কাউকে নিয়ে কিছু সৃষ্টি করতে ইচ্ছে হয় খুব। কবি
তাই তার প্রিয়তমার কথা ভেবেছেন বৃষ্টির কবিতায়। সৃষ্টির উল্লাসে। পল্লীকবি
জসিম উদ্দিনের মতোই বৃষ্টির সাথে প্রণয় করেছেন এই সময়ের আরেক কবি মুসাফির।
কবি তার মেঘের মেয়ে কাব্যগ্রন্থের শুরুতেই লিখেছেন-
বৃষ্টি আমার মিষ্টি প্রিয়া
মেঘ হলো তার মা,
আমাদের এই গোপন প্রণয়
কেউতো জানে না।
বাহ! বৃষ্টিকে নিয়ে কবির চিন্তা কত মিষ্টিময়। হ্যাঁ, কবিরা
এভাবেই বৃষ্টিকে তুলে এনেছেন সৃষ্টির ছড়ায়। প্রেমের প্রণয়ে। ভালোবাসার
আকাশে। আকাশের নীলে। কবি মুসাফিরের ভাষায়-
তুমি হঠাৎ এসে আকাশ নীলের পর্দা সরালে
মেঘের চোখে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরালে।
মনের বিরাণ মাঠে তুমি ফসল ভরালে
মুসাফির এই হৃদয়টাকে প্রেমে জড়ালে।
বৃষ্টি কবির সৃষ্টি এরকম অসংখ্য ভাবনা সত্যিই অকল্পনীয়। কবিরা
এভাবেই বৃষ্টিকে আপনার করে নিয়েছেন হৃদয়ের গহীণে। আদরের পরশে। ভাবনার হৃদয়
জমিনে। কবিদের বৃষ্টি নিয়ে এরকম হাজারো ভাবনার জগতে এসে নিজের গ্রামকে
নিয়ে ভাবলেন আরেকজন কবি। কবি যখন দেখেন চৈত্রের খাঁ খাঁ রৌদ্রতাপে তার
গ্রামের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, প্রকৃতি তার সহজাত বৈচিত্র্য হারিয়ে
ফেলছে, পুকুর নদী পানির জন্য কেঁদেকুটে আইচাই করছে, হাওড় বাওর শুকিয়ে খাঁ
খাঁ করছে, উধাও হচ্ছে মাছের ঝাঁক, খেয়াঘাটে মাঝি কুলিদের হাঁকডাক বন্ধ হয়ে
যাচ্ছে ঠিক তখনই কবি সরদার আবুল হাসান লিখলেন-
বর্ষারে তুই আয় না নেমে আমার সবুজ গাঁয়
টাপুর টুপুর বৃষ্টি নিয়ে সকাল ও সন্ধ্যায়
ব্যাঙ ব্যাঙাচি মাছ
শীর্ণ দেহ গাছ
জীবন পেয়ে উঠুক মেতে নতুন বরষায়।
বৃষ্টি নিয়ে সৃষ্টিতে কবির আকুতি কত আবেগময়। কতটা হৃদয়ের টান
জড়িত এখানে। নিজের গ্রামের জন্য কবির আকুতি কত মধুর। কত আবেগের। দেশের জন্য
কবির ভাবনা কত সুদূরপ্রসারী। দেশের আমজনতার জন্য কবির চিন্তা কতটা
উচ্ছ্বসিক। কবিদের সাহিত্য ভাবনা কতনা মিষ্টিময়। হোকনা সেটা বৃষ্টি নিয়ে
কিংবা অন্যকোন সৃষ্টিকে জড়িয়ে। সত্যসন্ধানী কবিদের সৃষ্টি সত্যিই এক বিশাল
সম্পদ। আমরা কবিদের কাছ থেকে এরকম ভালো কিছুই আশাকরি। বৃষ্টি নিয়ে আরো
ভেবেছেন কবি ফররুখ আহমদ। বৃষ্টি কোথায় এলো। কখন এলো। কেন এলো। কিভাবে এলো।
এর ফলাফলই বা কী হলো তা কবির ভাবনায় একান্ত আপনার করে।একান্ত নিজের করে।
কবির ভাষায়-
বৃষ্টি এলো কাশবনে
জাগল সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথায়রে
লুকিয়ে গেল বাঁশবনে।
হ্যাঁ, কবির ভাবনা সত্যিই সঠিক। আমরা দেখেছি বর্ষাকালের
বৃষ্টির সময় বকেরা দলবেঁধে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। কোন সুদূরে যেন ওরা
আপনার নীড় খুঁজে বেড়ায়। কবির ভাষায় তারই বহিপ্রকাশের অবলোকন দেখছি। বৃষ্টি
পেয়ে ঘাসেরা জেগে ওঠে আপনার করে। ওরা প্রাণ পায়। ওদের জীবনীশক্তি ফিরে আসে
নতুন করে। ওদের খেয়ে আমাদের গবাদিপশুরা প্রাণ পায়। ঘাসের জমিনে ছড়িয়ে পড়ে
গবাদিপশুরা। ফলে গবাদিপশুদের পদচারণায় সাড়া জাগে ঘাসবনে। কবিদের ভাবনা
এখানেও পাখনা মেলে! বৃষ্টির গুণ কীর্তন বর্ননা করে এসময়ের বিশিষ্ট ছড়াকার
কবি আসলাম প্রধান লিখেন-
বৃষ্টি এলে বনবাঁদাড়ে
বৃক্ষলতা গোসল সারে
কেউবা শুয়ে স্বপ্ন দ্যাখে
দীন দুখীদের কষ্ট বাড়ে।
আষাঢ় নামে টাপুর টুপুর
ঘুম ভাঙ্গে না সূয্যি কাকুর
আঁধার ভরা পূর্ণিমাতে
মুখ দেখিনা চাঁদনি আপুর।
কতইনা সুন্দর ভাবনা কবির। কবির আবেগ অনেক গভীরে। হৃদয়ের
গহীণে। বৃষ্টি এসে গাছদের গোসল করিয়ে দেয়। ফলে ওদের সজিবতা বৃদ্ধি পায়।
ওদের পবিত্রতা আরো আলোদীপ্ত হয়। অন্যদিকে বৃষ্টির দিনে যেমন আনন্দ আছে ঠিক
তেমনি কষ্টও রয়েছে সীমাহীন। দীন দুখীদের যেমন কষ্ট বাড়ে তেমনি যাতায়াতেও
সমস্যার সৃষ্টি হয় জনসাধারণের। দাম বাড়ে বাহনের। বাহানা বাড়ে রিকশাওয়ালার।
কবির ভাষায়-
সেগুন গাছে কাকের ছানা
যাবে কোথায় নেই ঠিকানা
রিকশাওয়ালা ভাড়ায় যেতে
নানারকম তালবাহানা।
হ্যাঁ, বর্ষার দিনে যাতায়াতের বেশ কষ্টই হয়। রাস্তাঘাট
কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে। হাজারো খানাখন্দের সৃষ্টি হয়। ফলে যাত্রীবাহিদের কষ্টের
সীমা থাকে না। কবিদের লেখায় সেটিও ফুটে উঠেছে বাস্তবতার নিরিখে।
অতিবৃষ্টির ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়। ডুবে যায় বাড়িঘর। ভেসে যায়
চর। চরাঞ্চলের লোকজনেরা কষ্টে পরে। চাষীর চোখে শোকের পানি ঝরে। স্বাভাবিক
বেঁচে থাকার আশায় ছেদ পরে। তাই চরের লোকেরা আর বৃষ্টি চায় না। চায় না
বৃষ্টিতে সৃষ্টি হোক অকাল বন্যার। এসময়ের আরেকজন সমাজ সচেতন কবি তা ভেবেছেন
আপনার করে। একান্ত নিজের করে। কবি ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দের ভাষায়-
বর্ষা যখন ডুবায় বাড়ি ঘর
কিংবা যখন ভাসায় দুখির চর
চাষীর চোখে শোকের পানি ঝরে
বাঁচার আশা চুপটি কেঁদে মরে
চাইনা এমন দুখের পানি
খুশির ধারায় বৃষ্টি তুমি দাও
বাঁচাও ফসল পুকুর নদী
পাল ছড়ানো নাও।
বৃষ্টির কারনে আমাদের কোন ক্ষতি হোক কবিরা তা চান না।
বৃষ্টিতে নেমে আসুক রহমধারা এটিই কবিদের চাওয়া। খুশির ধারার বৃষ্টি নামুক
জগতের বুকে এই আশা কবিদের। বৃষ্টির পানিতে ক্ষতি নয়, নদীতে জলোচ্ছ্বাস নয়
কিংবা পালতোলা নায়ের ডিগবাজি নয়, কবির চাওয়া আনন্দের। কবির চাওয়া রিমঝিম
বৃষ্টির পানিতে আনন্দ উল্লাস। বৃষ্টির পানিতে ক্ষেতের ফসল, মাছের পুকুর
টইটম্বুর হবে, চাষীর মুখে, জেলের মুখে মিষ্টি ফুলের হাসি ফুটবে। রাখালের
কন্ঠে বেজে উঠবে বাঁশির সুর। কবির চাওয়া এমনই সুখের। এমনই আনন্দের। আমাদেরও
তাই। কবির ভাষায়-
রিমিঝিমি বৃষ্টি যখন ঝরে
ক্ষেতের ফসল মাছের পুকুর
টইটম্বুর ভরে,
চাষীর মুখে জেলের মুখে
মিষ্টি ফুলের হাসি
রাখাল ছেলের বাঁশি।
বৃষ্টির পরশে আমরা এমনটিই আশাকরি। বর্ষার এই সময়ে আমাদের
সৃষ্টি সুখের উল্লাস বারুক সে কামনাই রইলো। বৃষ্টি নিয়ে কবিরা শিশুকালের
স্মৃতি নিয়েও সৃষ্টি করেছেন অনবদ্য কাব্যমালা। বৃষ্টির ছড়ায় শিশুকালের
আনন্দঘন সময়ে ঘুরে এসেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরুর ভাষায়-
দিনের আলো নিবে এলো
সূয্যি ডোবে-ডোবে,
আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে
চাঁদের লোভে লোভে।
মেঘের উপর মেঘ করেছে-
রঙের উপর রঙ,
মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা
বাজল ঠঙ ঠঙ।
ও পারেতে বিষ্টি এল,
ঝাপসা গাছপালা।
এ পারেতে মেঘের মাথায়
একশো মানিক জ্বালা।
বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান-
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদেয় এলো বান।
হ্যাঁ, কবির ভাবনা সঠিক। বৃষ্টির পানিতে নদীতে বন্যার সৃষ্টি
হয়। আর সেই নদীতে গোসল সেরে মজা পায় শিশুরা। কিশোরেরা। বন্যার নতুন পানিতে
গোসল করার মজাই আলাদা। বৃষ্টির পানিতে সৃষ্টির উল্লাসে মুখরিত হয় পাড়াময়।
গ্রামময়। বন্যার নতুন পানিতে মাছ ধরার স্মৃতিচারণ মনে করে কবি বৃষ্টির
সৃষ্টিতে মেতে ওঠেন। কবির ভাষায়-
আষাঢ়ে বাদল নামে
খালবিল থইথই,
শিশুরা জলকেলিতে
করে মজা হইচই।
এমন দিনে মাছ ধরার
মজাটাকে ভুলিনি,
জেলে মাঝি সাজি তবু
গামছাটা খুলিনি।
ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাকছে
কোলাব্যাঙের নাতি,
ওর ডাকে ধরি মাথায়
কলাপাতার ছাতি।
হ্যাঁ। আজকে খুব মনে পরে সেই শিশুকালের স্মৃতিচারণ। আমরা তখন
অনেক ছোট। প্রাইমারির ছাত্র। সবেমাত্র পড়াশোনায় হাতেখড়ি। ঠিক সেই সময়ে যখন
স্কুলে যেতাম, সাথে ছিলো না ছাতা, কিন্তু বৃষ্টি এসেছে নেমে। কি করা তখন।
হ্যাঁ, কাছের কলাবাগান থেকে কলাপাতা কেটে ছাতা বানিয়েছিলাম অনেকেই। কেউবা
কচুপাতা দিয়েও ছাতা বানাতাম। শিশুকালের সেই স্মৃতি আজ অধরাই থেকে যাচ্ছে।
এসময়ের শিশুকিশোরেরা কলাপাতার ছাতা চিনবে না। কচুপাতার ছাতাও ওরা দেখে না।
কারণ সময় এখন আধুনিক। আধুনিকতার স্বপ্ন আকাশে ওরা বিলীন। প্রকৃতির সহজাত
সৃষ্টি থেকে ওরা বঞ্চিত। ওদেরকে অতীতের নিদর্শনগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে
হবে আমাদেরকে। কবিদেরকেই। আজকের নবীনদের দেখাতে হবে আলোর পথ। সত্যের পথের
দিশা দিতে হবে আমাদেরকেই। তাই কবিদের সাথে একাত্নতা ঘোষণা করে আমিও ছন্দ
ছড়ায় বলতে চাই-
বৃষ্টি দিয়ে সৃষ্টি হোক আলোর বান,
সেই বানে ডুবে যাক কালোর মান।
* কবি, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক
No comments:
Post a Comment