বাংলাদেশেও হোক ‘মি টু’ আন্দোলন
মোহাম্মদ অংকন
বিশ্বব্যাপী
নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে, নারী-পুরুষ সম অধিকার প্রতিষ্ঠা হতে
চলেছে, পুরুষের পাশাপাশি নারীরা এখন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে, অফিস-আদালতে
নারীদের কর্মসংস্থান বাড়ছে; কিন্তু কোনোক্রমেই নারীদের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন
বন্ধ হচ্ছে না। যৌন হয়রানির চর্চা এখন সবর্ত্র। কোথাও নারীরা নিরাপত্তাবোধ
করছে না। গৃহে হোক, অফিস-আদালতে হোক, চাষাবাদের কাজকর্মে হোক, মজুরের
কাজকর্মে হোক, গণপরিবহনসহ অন্য যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক, ধনী-দরিদ্র,
সাদা-কালো নির্বিশেষে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের মত
জঘন্য ঘটনা নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটে চলেছে। সবই কি আর মানুষের চোখে ধরা পড়ছে?
কিংবা নিপীড়িত-নির্যাতিত সকল নারীই কি তাদের যৌন হয়রানি-নিপীড়নের কথা
প্রকাশ করছে? হ্যাঁ, অধিকাংশই মুখ খুলছে না। একটি পরিসংখ্যানে এসেছে, যৌন
হয়রানি-নিপীড়নের শিকার ৭৫ শতাংশ নারী মুখ খোলে না এবং ঘটনাগুলো লোকচক্ষুর
অন্তরালে চলে যায়। যৌন হয়রানি-নিপীড়নের শিকার হয়েও নারীদের মুখ না খোলার
অনেক কারণই রয়েছে। আইনি জটিলতা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে
প্রতিহিংসা-প্রতিরোধের প্রভাব ও সামাজিক দায়বদ্ধতা, কর্মক্ষেত্রে কর্মের
সুযোগ হারানোর ভয় ইত্যাদি। তবে সম্প্রতি ‘মি টু’ আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতায়
অনেক নারীই আজ যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার হতে চলেছে। এ
আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে অনেক ক্ষমতাসীন নারী, জনপ্রিয় অভিনেত্রী এবং যারা কোনো
না কোনোভাবে জীবদ্দশায় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল। সময়ের বিবেচনায় তারা
মুখ খুলে নারীদের যৌন হয়রানি, নিপীড়ন, নির্যাতন বন্ধে বিশ্বব্যাপী ‘মি টু’
আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে চলেছে। বিশ্বায়নের যুগে এসে যৌন
হয়রানি-নিপীড়ন-নির্যাতন প্রতিরোধে নারীদের ‘মি টু’ আন্দোলনকে আমি স্বাগত
জানাচ্ছি।
‘মি টু’ আন্দোলনে একটু একটু করে অনেকেই সরব হচ্ছে।
টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজর দিলে তার যথেষ্ট
প্রমাণ মিলছে। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে হ্যাশ ট্যাগ ‘মি টু’ (#me too)
লেখার মাধ্যমে তা বিশ্বব্যাপী প্রসারিত হতে চলেছে। এবং বিশ্বের বহুল
প্রচারিত প্রিন্ট মিডিয়ায় নারীদের অভিনব এ আন্দোলন নিয়ে প্রতিনিয়ত
প্রতিবেদন আসছে। নারীদের সংগ্রামের কথা আসছে যাতে ‘মি টু’ অনুপ্রেরণা
যুগিয়েছে। নারীরা এতে সচেতনতা সৃষ্টির সুযোগ পাচ্ছে। সচেতন হচ্ছে
চলচ্চিত্র, ক্রীড়া জগতের তারকারা অথবা রাজনৈতিক মহলের অনেক নারীই। ২০০৬
সালে প্রথমবার ‘মি টু’ আন্দোলন জনসমক্ষে উঠে আসে। তারপর থেকে ‘মি টু’
আন্দোলন ক্রমশ জোট বাঁধতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় সোশ্যাল
অ্যাক্টিভিস্ট তারানা বুর্ক এই আন্দোলন প্রথম শুরু করেন, এমনটাই জানতে
পেরেছি। যৌন হয়রানি, নিপীড়ন, নির্যাতন এবং নারীদের বিরুদ্ধে হওয়া সকল
অন্যায়ের কথা প্রকাশ্যে তুলে আনার জন্য তিনি প্রথম সকলকে উৎসাহিত করতে শুরু
করেন। যে নারীরা কোনো না কোনো সময় এই যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে, স্বামী
কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছে, তাদেরকে এই ‘মি টু’ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান
করেন। আমি মনে করি, তারানা বুর্কের আহ্বানকৃত আন্দোলনটির ওজন ক্রমশ ভারি
হতে চলেছে। এতোটাই যে তার বিশেষত পাশ্চাত্যের শিল্প-সংস্কৃতি জগৎ,
সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থা, সংবাদ মাধ্যম এক কথায় সমাজের সমস্ত স্তরে
অসংখ্য অবৈধ যৌনকামী পুরুষ যেন আতঙ্কিত হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে
ছাত্রীদের, নিয়োগকারীর বিরুদ্ধে নিযুক্তের অভিযোগের তীর যেন কেবলই ধেয়ে
আসছে। কাজের জায়গায় বিশেষ করে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত কাজে নিজস্ব ক্ষমতার
অপব্যবহার করে, কখনও ভয় দেখিয়ে নারীদের প্রতি যারা অন্যায় যৌনাচরণ করেছেন,
হঠাৎই যেন এই ‘মি টু’ আজ সেই সব নামী দামী ব্যক্তিদেরও কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে
দিচ্ছে। এবং শাস্তির ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। চলনমান ‘মি টু’ আন্দোলনটিকে
সমাজে সুশৃঙ্খলভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলে, বিশ্বব্যাপী যৌন হয়রানি শূণ্যের
কোঠায় নেমে আসবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
সম্প্রতি ‘মি টু’ আন্দোলন
নিয়ে ভারতে তুলকালাম কান্ড ঘটছে। একের পর এক অভিযোগ আসছে, আলোচনা হচ্ছে।
অভিযুক্তের সামাজিক, অবস্থানগত ও পেশাগত প্রতি ন্যূনতম ছাড় না দিয়ে এই
আলোচনা চলছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অভিযোগও উঠেছে প্রমাণের আগেই অভিযুক্তকে
অপরাধীর সামাজিক কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর। এই সব অভিযোগ উঠার পর অভিযুক্তদের
অনেকেই অস্বীকার করছেন, সে অস্বীকার মিডিয়া পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে। যৌন হয়রানি
এই সব অভিযোগ সামাজিক মাধ্যম, গণমাধ্যম, খেলাধুলা, চলচ্চিত্র অঙ্গন,
অফিস-আদালত, পুলিশ-প্রশাসন, রাজনীতি, রাজনীতিবিদ সকল মহলেই আলোড়ন তুলেছে।
‘মি টু’ আন্দোলনের জন্ম ভারতে না হলেও যেভাবে ভারতে এর প্রভাব পড়তে শুরু
করেছে তা অন্যান্য রাষ্ট্রের জন্য সত্যই অনুপ্রেরণামুলক। ভারতের ‘মি টু’
আন্দোলনকে আমরা ‘স্টার জলসা’ কিংবা ‘জি বাংলা’র ধারাবাহিক সিরিয়ালের মত
উপভোগ করতে পারছি না। নিছক দর্শক হয়ে এখনও নারীরা ‘মি টু’ আন্দোলনকে গ্রহণ
করছে। বাংলাদেশের নারীরা এখনও জাগছে না। নিজের সম্মানহানি হোক, এটা এদেশের
বোধহয় কেউ চায় না! কিন্তু যৌন হয়রানি-নির্যাতন কি সম্মানহানির অংশ নয়? এ
কথা বলার কারণ, বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত নারীরা যৌন হয়রানি, নির্যাতনের শিকার
হচ্ছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত উদ্যোগ নানা থাকার কারণে যৌন পিপাসুরা
অবারিত সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। তাহলে নিপীড়িত নারীদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশেও ‘মি
টু’ আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন নয় কি? অনেকেই ভাবছে, দেশব্যাপী
আন্দোলনটা ছড়িয়ে পড়লে, তাতে অংশগ্রহণ করব। এজন্য হয়ত আমাদের আরও কিছুদিন
অপেক্ষা করতে হবে। তবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশে যৌন
হয়রানি, নিপীড়ন প্রতিরোধে ‘মি টু’ আন্দোলন এখনই অত্যাবশকীয় হয়ে পড়েছে।
দেশের মহিলা সংগঠন, মহিলাকর্মীসহ নারী সংগঠকদের এ বিষয়ে দ্রুত ভেবে দেখার
অনুরোধ করছি- বাংলাদেশে নারীদের যৌন হয়রানি, নিপীড়ন প্রতিরোধের প্রেক্ষিতে
‘মি টু’ আন্দোলন কতটা যৌক্তিকতাপূর্ণ।
‘মি টু’ আন্দোলনটি সামাজিক
যোগাযোগ (ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি) মাধ্যমকেন্দ্রিক। প্রায় দেশে
সামাজিক মাধ্যমকে সুস্থখাতে প্রবাহিত করে এ ধরনের অনেক আন্দোলনকে বেগবান
করে চলেছে। অথচ আমাদের দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের একটা বড়
অংশ আজ অসুস্থতায় মেতে রয়েছে। এদের অনেকেই এগুলো নিছক ব্যবহার করে চলেছে,
যার অধিকাংশই শালীনতার সঙ্গে অসুস্থ ও অশালীনের ভেদ নির্ণয়ে অক্ষম। এখনও
আমাদের দেশের অনেক সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী ওই মাধ্যমেই আসে কেবল
রাজনীতি আর ধর্মের জোশে। এখনও অনেক ব্যবহারকারী যখন যেকোনো ধরনের বিকৃত
বার্তা ছড়ায় (গুজব) ও ছবি বিকৃতি করে পার পেয়ে যায়, তখন সে ভাবে- এগুলো
কোনো অপরাধ নায়! তবে তারা সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ‘মি টু’ আন্দোলনকে কিভাবে
গ্রহণ করে সঠিকখাতে ব্যবহার করবে সে প্রশ্নটি রয়ে যায়। মানুষ যখন অস্ত্রের
যুদ্ধ থেকে প্রযুক্তির যুদ্ধকে প্রাধান্য দিতে চলেছে, সে সময়ে ‘মি টু’
আন্দোলন যদি দেশীয় ভাবমূর্তি রক্ষার্থে নারীদের যৌন হয়রানি-নিপীড়ন বন্ধ না
করতে পারে, তাহলে সবর্ত্র যে প্রযুক্তির অপব্যহার হচ্ছে তা নিশ্চিত করে বলা
যায়। কেউ কি বলতে পারবে, আমাদের দেশের নারীরা কর্মক্ষেত্রসহ প্রতিটা পদে
পদে যৌন হয়রানি-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে না? অবশ্যই হচ্ছে। যে বলবে ‘না’, সেই
নিপীড়ক, নির্যাতনকারী! আমাদের দেশের অনেক পুরুষের মধ্যে এখনও মধ্যযুগীয়
মানসিকতা রয়ে গেছে, নারীমাত্রই তারা ভোগের বস্তু বলে মনে করে। কিন্তু
নারীরা নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েও মুখ খোলার সাহসটা পায় না। কারণ দিনশেষে সেই
নারীর ঘাড়েই দোষের বোঝা বেঁধে দেবে পুরুষনিয়ন্ত্রিত এই সমাজ। এখানে তাই
ধর্ষক ও নিপীড়কেরা বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়ায়, আঁচলে মুখ চাপা দিতে হয়
নির্যাতিতা নারীদেরকে। এমন একটা পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে ‘মি টু’ আন্দোলন
কতটা প্রয়োজন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতসহ বিশ্বব্যাপী ‘মি টু’
আন্দোলন যখন নারীদেরকে রক্ষায় রাস্তায় নেমেছে, তখন এর প্রভাব বাংলাদেশে
কতটুকু পড়ে সেটাই এখন দেখার বিষয় হয়ে উঠেছে। তবে প্রত্যাশা করব, ‘মি টু’
কিংবা এর সমকক্ষ, সম্মিলিত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ থেকে নারী
নির্যাতন-নিপীড়ন ও যৌন হয়রানি বন্ধে সকলেই যেন প্রকৃত আন্দোলন করে। এ বিষয়ে
নারীদের গৃহিতপদক্ষেপকে সমর্থন দিয়ে পুরুষদের অংশগ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় বলে
আমি মনে করছি।
লেখক: নারীবাদী ও কলামিস্ট, ঢাকা।
No comments:
Post a Comment